ভিডিও

শুধু শোকের মাতম নয়, চাই সুদৃঢ় প্রতিরোধ

আতাউর রহমান মিটন

প্রকাশিত: মার্চ ০৪, ২০২৪, ০৬:৫৩ বিকাল
আপডেট: মার্চ ০৪, ২০২৪, ০৬:৫৩ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে সংঘটিত অগ্নিকান্ডের খবর নিয়ে লিখতে অস্বস্তি হচ্ছে। কারণ, এটা তো দুর্ঘটনা নয়, অবহেলাজনিত হত্যাকান্ড! শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রায় ৪৬ জন মানুষ বিভীষিকাময় সেই অগ্নিকান্ডে নিহত হয়েছেন।

হাসপাতালে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন আরও ১২জন যারা শঙ্কামুক্ত নন। এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ১৫ জন নারীসহ ৭৫ জনকে। একটা করে বিপর্যয় নামে আর সরব হই, সুপারিশ দেই কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ ও প্রতিকার হয় কতটুকু তা নিয়ে জনমনে বিস্তর সংশয় বিদ্যমান।

ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত ঢাকায় বসবাসরত বগুড়ার প্রতিশ্রুতিশীল কবি ও আবৃত্তিকার শান্ত মাহমুদ তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, “এই মানুষগুলো আমার কেউ নয়। না আত্মীয়, না বন্ধু, না স্বজন। কিন্তু স্বজন হারানোর কষ্ট আমাকেও তীব্র শোকে পাথর করেছে আজ।” পাঠক চাইলে শান্ত মাহমুদ এর নিজের কণ্ঠে সেই হৃদয় ছোঁয়া আবৃত্তি শুনতে পারেন তার ফেসবুক পেজ-এ।

শান্ত মাহমুদ প্রশ্ন রেখেছেন, “কোন ভাষায় সমবেদনা জানাবো এই পরিবারগুলোর বেঁচে থাকা স্বজনদের?” আর আমার নিজের প্রশ্ন, ‘বেইলি রোডের এই মর্মান্তিক ঘটনা কী আমাদের কিছু শেখাবে? এভাবে স্বজন হারানোর দায় কার?’ আমি জানি, সকলেই আজ নিরুত্তর! সকলেই যেন শোকে পাথর হয়ে আছেন! কিন্তু এভাবে মুখ বুজে সব সহ্য করা, আর কতদিন?


শুধু আমি বা শান্ত মাহমুদ নই, স্বজন হারানোর কষ্টে স্তম্ভিত আজ পুরো জাতি। আমরা বাকরুদ্ধ, আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা এর সঠিক তদন্ত চাই, আমরা বিচার চাই। কিন্তু কার বিচার করা হবে, আর কে সেটা করবে? আমরা তো অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই অগ্নিকান্ডের তদন্ত কমিটি হবে।

রিপোর্টে লেখা হবে কিছু কিন্তু আড়ালে ঢাকা থাকবে নিষ্ঠুর সত্য আর অবহেলার তরতাজা প্রমাণগুলো। কান টানলে যে মাথা আসবে, তাই কোন কিছুতেই আর টানাটানি হবে না। সবাই ভুলে যাবে সব! শুধু স্বজন হারানোর ব্যথা বয়ে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়ে রাখবে কিছু মানুষ!

ঢাকা এক আজব শহর। এই শহরে প্রতিদিন পিঁপড়ার মত ছুটে আসছে মানুষ। শত শত মানুষ প্রতিদিন নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ঢাকা শহরে মানুষের কাফেলায়। তাদের বিনোদনের স্থান এতই সংকুচিত যে রাজধানীতে এখন সবার কাছে রেষ্টুরেন্ট বা খাবার দোকানগুলোই ভরসা। তরুণ-তরুণীদের কাছে তো বটেই, বিজনেস আড্ডা, সামাজিকতা, উৎসব উদযাপন থেকে নানা কারণে মহানগরীর মানুষগুলো ছুটছে রেষ্টুরেন্ট বা ফাষ্ট ফুড এর দোকানগুলোতে।

নদীর ধার, পার্কের গাছের ছায়া কিংবা খোলা মাঠ ইত্যাদি এত মারাত্মকভাবে দখলে-দূষণে ভরে উঠেছে যে মানুষ এখন বাইরে যাওয়া বলতে রঙীন আলো ধাঁধানো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত খাবার দোকানগুলোকেই বোঝে। প্রশ্ন উঠেছে, এসব বাহারী খাবারের দোকানগুলো আদৌ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত কি না? প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজধানীতে একটি খাবারের দোকান খুলতে হলে কমপক্ষে ৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন নিতে হয়।

সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, রাজউক কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে। মেয়াদান্তে এসব অনুমোদন নবায়ন করার কথা। নবায়নের অন্যতম শর্ত হওয়ার কথা ছিল, সংশ্লিষ্ট দপ্তর কর্তৃক সরেজমিন তদন্তপূর্বক সবকিছু ঠিকঠাকমত আছে কিনা সেটা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রায় সকল ক্ষেত্রে এই নিয়মের উপস্থিতি নেই। যেটা আছে সেটা হচ্ছে ‘ঘুষ’ বা ‘বখশিস’।

এটা দিয়েই ‘ম্যানেজ’ হয় ছাড়পত্র বা নবায়নের সনদ। সরকারের পদস্থ সকলেই এসব দুর্নীতি, অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনার কথা জানেন কিন্তু কোন প্রতিরোধ নেই। অদ্ভুতভাবে ‘নীরব’ সকলেই। বেইলি রোডের আগুন লাগা ভবনটি সাততলা। তৃতীয় তলা ছাড়া পুরো ভবনটিতেই ছিল খাবারের দোকান।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আগুনের সূত্রপাত নীচতলার একটি খাবারের দোকান থেকেই। প্রত্যেক ভবনে এবং নীচ থেকে উপর পর্যন্ত সিঁড়িতে থাকা একাধিক গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে ওঠে। ভবনটিতে বাতাস চলাচলের সুবিধা সংকুচিত থাকায় ধোঁয়ায় শ্বাসনালী পুড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটে। কারণ, তাঁদের শরীরে পোড়ার ক্ষত তেমনটা দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল সূত্র।

ঢাকার বেশিরভাগ ভবনের “ব্যবহার উপযোগী সনদপত্র” নাই বলে রাজউক নিজেরাই স্বীকার করে। অনেক ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকরা সেটা সম্পর্কে জানেনও না। বিশেষ করে, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে এখন বহুতল ভবনে খাবারের দোকান খোলার রমরমা অবস্থা চলছে।

এসব ভবন নির্মাণের সময় খাবারের দোকান, যেখানে বড় আকারের রান্নাঘর বা চূলা থাকবে সেটা বিবেচনায় নিয়ে ডিজাইন করা হয়নি। ফলে, খুব সহজেই গ্যাস সিলিন্ডার বা অন্যান্য উৎস থেকে সূচিত অগ্নিকান্ড মারাত্মক হয়ে ওঠে। কি কাজে ব্যবহৃত হবে সেটার উপর ভিত্তি করে বিল্ডিং এর ডিজাইন করতে হয়। বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনায় এবং নির্মিত ভবন ব্যবহারে সে নিয়ম মানা হয় না।

এটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। বহুতল ভবনগুলো থেকে রেঁস্তোরা সরিয়ে ফেলতে হবে নয়তো সেখানে নিরাপত্তা প্রটোকল নিশ্চিত করেই কেবল অনুমোদন দিতে হবে।

ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে এসব অনিয়ম তুলে ধরতে হবে এবং সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির প্রমাণ দিতে হবে। খাবারের দোকানের আড়ালে ভবনগুলো যে একেকটা আগুনের চুল্লি হয়ে আছে সেটা বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের কঠোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এর জন্য খুবই জরুরী।

একটি দুর্ঘটনা ঘটার পরে জানা যায়, ‘ভবনটিতে অগ্নি নির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না’। বেইলি রোড এর অগ্নিকান্ডেও এই কথা বলা হলেও তা দেখার দায়িত্ব যাদের তারা কেন চোখ বন্ধ করে রেখেছে সেটা কেউ দেখছে না কেন?

সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি ঘুষ, দুর্নীতি এবং এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখতে পারে না? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি এসব অনিয়মের কিছুই জানেন না? তাহলে তার ‘জিরো টলারেন্স’ এর ঘোষণা কি কেবলই মুখের কথা? ঢাকা শহরে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি শোনা যায় আগুন নেভাতে পানি সংকটের কথা।

অতীতের সবগুলো বড় বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পানি সংকটে হিমশিম খাওয়ার কথা বললেও এই পানির সংকট সমাধানে আমাদের উদ্যোগ এখনও ঢিলেঢালা। একসময় যে শহরে ছিল খাল-বিল ও বড় বড় পুকুরের সমাহার, প্রাণের সেই শহরে এখন পানির সংকট। কিন্তু কেন?

সরকারকে অবিলম্বে পুরো শহরে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি উন্মুক্ত জলাশয়গুলো সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। দখলে-দূষণে হারিয়ে যাওয়া পুকুর ও খালগুলো উদ্ধারে মনোনিবেশ করতে হবে। এ নিয়ে কোন কালক্ষেপণ গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিস ইউনিটকে শক্তিশালী করা এবং তাদের ওয়ার্ক ষ্টেশন বৃদ্ধির তৎপরতা দৃশ্যমান। কিন্তু অনিয়মের ধুলাবালিতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি তার সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। সরকারকে এ ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। অগ্নিকান্ডের কারণ এবং করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভবন ও বাসাবাড়িতে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয় না এবং এ কারণেই এ ধরণের দুর্ঘটনার সময় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায় না।

অগ্নি নিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরী। এটা বাড়ি নির্মাণের সময় মূল নকশার সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে


১. ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা,

২. অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাসহ ভবনে আগুন প্রতিরোধী উপাদান ব্যবহার

৩. ভবনে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো

৪. জরুরী বহির্গমন পথ রাখা ও সহজে ব্যবহার নিশ্চিত করা

৫. ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা ও ব্যবহার করা,

৬. স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম (তাপমাত্রা ৫৭ ডিগ্রির বেশি হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটায়)

৭. আগুন লাগা প্রতিরোধ ও আগুন লাগলে করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি

সরকারের উপর আমরা সবকিছুর দায় চাপাচ্ছি বটে তবে জনগণের নিজস্ব বিবেক ও বুদ্ধির বাস্তবানুগ ব্যবহারও তো করতে হবে। আমরা লোভের রঙিন চশমা দিয়ে সবকিছু দেখার চেষ্টা করছি, দায়িত্বের চশমা দিয়ে নয়। অথচ দুর্ঘটনা হলে ক্ষতি তো হয় আমার নিজেরই।

স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যায় আমারই প্রিয় কোন স্বজনের। তাই দায়িত্ব কিছুটা আমাদেরও নিতে হবে। দায়িত্ববোধ থেকেই  সরকারের কাছে দাবী জানাতে হবে, দাবী আদায়ে সরকারের উপর চাপ তৈরী করতে হবে আবার নিজেরাও নিজেদের করণীয় কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে।

বেইলি রোড এর অগ্নিকান্ডে নিহত স্বজনদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। শোকার্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। সরকার কোনভাবেই এই দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারবে না। যদিও জীবনের দাম দেয়া সম্ভব নয়, তবুও নিহতদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবী জানাই।

এই ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে অবহেলায় জড়িত বাড়ির মালিক, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেও অর্থ প্রদানে বাধ্য করতে হবে। দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। শুধু শোকের মাতম নয়, প্রতিরোধের দৃঢ় ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS