ভিডিও

পাহাড় সমান ঝঞ্ঝা ও শঙ্কা নিয়ে আওয়ামী লীগ এগোচ্ছে

মাশরাফী হিরো

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৪, ০৬:৩৬ বিকাল
আপডেট: জুন ২৩, ২০২৪, ০৬:৩৬ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

আওয়ামী লীগ প্রায় ১৬ বছর একটানা রাষ্ট্র ক্ষমতায়। যা এখনকার প্রজন্মের কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও ৭৫ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে যারা রাজনীতি করেছেন তাদের কাছে অনেকটা অস্বাভাবিকই মনে হয়। ক্ষমতা তাদের কাছে ছিলো চন্দ্র জয়ের মত অভাবনীয় বিষয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনা নিয়ে রাজনীতি শুরু করেনি। বরং জনগণের অধিকার রক্ষাই ছিলো তার মূল উদ্দেশ্য।

মুসলীম লীগ সরকারের সীমাহীন নির্যাতন আর নিপীড়ন মানুষকে ভিন্ন কিছু ভাবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলো। তাছাড়া ভাষা আন্দোলনের বীজও বপন হয়েছিলো ১৯৪৮ সালে। কায়েদে আজম জিন্নাহ্ ঘোষণায় মন ভেঙে গিয়েছিলো বাঙালির। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম। মুসলীম লীগ সরকারের ক্রমাগত ব্যর্থতা আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলো।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর মাওলানা ভাসানী জন্ম দিলেন আওয়ামী লীগের। কারাগারে থেকেই বঙ্গবন্ধু হলেন একমাত্র যুগ্ম সম্পাদক। ততদিনে বঙ্গবন্ধুর জেলখাটা শুরু হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু বলতেন জেলখানা তার আসল বাড়ি। তার সন্তানরা জানতেন বাবার বাড়ি। বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গেলেই সন্তানরা বলতেন আমরা বাবার বাড়ি যাচ্ছি বাবাকে দেখতে।

জীবনের ১৪টি বৎসর তিনি কাটিয়েছেন কারাগারে। জামিন লাভের পর কতবার যে কারা ফটক থেকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার হয়েছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। বিনা বিচারে দিনের পর দিন জেল খেটেছেন। এমনও হয়েছে সন্তানরা তাকে চিনতেও পারতেন না। একটা মানুষ জেলখানায় গেলে তার পরিবার যে কি অমানসিক যন্ত্রণায় থাকে তা বোঝানো মুশকিল।

যারা ভুক্তভোগী তারাই শুধু বোঝে। বৃদ্ধ মাওলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক গেলেন জেলখানায়। মুক্তি দিতে চায় না পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন মনে করতেন একই সাথে যদি আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে জেলখানায় রাখা যায় তাহলে আওয়ামী লীগ দমে যাবে। বৃদ্ধ ভাসানী প্রস্টেট সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি হলেন।

আর শামসুল হক থেকে গেলেন জেলখানায়। দীর্ঘদিন জেলখানায় থাকতে থাকতে মস্তিস্ক বিকৃতি দেখা দিলো। মুসলীম লীগ সরকার পুরোপুরি পাগল না হওয়া পর্যন্ত শামসুল হককে ছাড়লো না। তার স্ত্রী আফিয়া খাতুন শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমালেন। দীর্ঘদিন পর মুক্তি পেয়ে পাগলের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকলেন তিনি। পরর্তীতে তাকে পাকিস্তানের লাহোরে পাঠানো হলো চিকিৎসার জন্য। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হলেন না। স্ত্রী এবং সন্তানদের সাথে একত্রে থাকতে পারলেন না।

আলাদা হয়ে গেলেন তারা। রাস্তায় রাস্তায় আবারও পাগলের মত ঘুরতে থাকলেন। এক সময় নিখোঁজ হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে তিনি মারা যান। এভাবেই হারিয়ে গেলেন আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক। অথচ তার একটা স্বাভাবিক জীবন থাকতে পারতো। সন্তানরা হারিয়ে ফেললো তার পিতাকে। দেশ হারালো একজন রাজনীতিবিদকে। এ ত্যাগ কখনো ভুলবার নয়।

১৯৬২ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা থেকে সভা করে ফেরার পথে করাচিতে গ্রেফতার হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের ডাক দিলেন। গ্রেফতার হলেন বঙ্গবন্ধু নিজেও। কিছুদিন পর তারা মুক্তি পেলেন। সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারলেন না হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে তিনি আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হক অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হলেন। আসলো আইয়ুব খানের ভোট। অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি বললেন ভোট দিতে যাবেন। সবাই তাকে বললো আপনার ভোটাধিকার নেই। ক্ষোভে-দুঃখে তিনি বললেন, হে আল্লাহ যে দেশে আমার ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নাই সে দেশ থেকে আমাকে তুলে নাও। ভোটের আগের দিন ১৯৬২ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। ১৯৪৫ সালের কথা।

বঙ্গবন্ধু তখনো মুসলিম লীগে আছেন। দলে উদারপন্থী আর কট্টরপন্থীদের লড়াই চলছে। বঙ্গবন্ধু উদারপন্থীদের পক্ষে। আবুল হাশিম তাদের নেতা। কিন্তু কট্টরপন্থীরা মানেন না। তার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুই পক্ষের মাঝামাঝি অবস্থান নিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নাছোড় বান্দা। আবুল হাশিমের বাগ্মিতায় এবং বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তায় কাউন্সিলররা তাদের পক্ষে চলে গেলো।

সোহরাওয়ার্দী সাহেব সিদ্ধান্ত দিলেন গণতান্ত্রিক পন্থায় এর সমাধান করা হবে। ভোটে কট্টরপন্থীরা পরাজিত হলো। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তিনি মুসলিম লীগের সভায় যোগ দিচ্ছেন তার নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে। হঠাৎ তার বাবার চিঠি এলো তার কাছে। শরীর খারাপ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের। গোপালগঞ্জ সম্মেলন শেষে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

নদীতে সমীর মাঝির কাছেই সব শুনতে পেলেন। তার প্রথম সন্তানের জন্ম এবং মৃত্যুর কথা। বাড়ি ফিরে মা অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন ছেলে হয়েছিলো। দেখতে ঠিক তোর মতো। কয়েকদিন বেঁচে ছিলো। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শুধু বললেন কয়টা দিন আগে আসতে পারলে না। ছেলের মুখটা তোমাকে দেখাতে পারলাম না। বিমর্ষ হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু।

ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বললেন, কাল সকালে ছেলের কবর জিয়ারত করো। সকালে ঘুম থেকে উঠে কবর জিয়ারত করলেন প্রথম সন্তানের। যার মুখ পর্যন্ত তিনি দেখতে পাননি। এ যে বাবা হিসেবে কতটা বেদনার তা কেবল বাবারাই বুঝতে পারে। তারপরও বঙ্গবন্ধু রাজনীতি ছাড়েননি। হাজারো কষ্ট নিয়ে আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

আওয়ামী লীগের জন্য তিনি পরিবার ছেড়েছেন। ছেড়েছেন মন্ত্রীত্ব। খেটেছেন জেল। বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ৬ বছর শেখ হাসিনা দেশে আসতে পারেননি। হত্যা করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, প্রথম অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী, প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ কামরুজ্জামানকে।

হত্যা করা হয় বহু মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। কত স্ত্রী বিধবা হলো, কত সন্তান পিতা হারা হলো সে খবর কেউ রাখলো না। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। ঢুকতে পারেননি ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারের বাড়িতে। তার উপর গ্রেনেড হামলাসহ ১৯ বার হামলা হয়েছে। স্বৈরাচার এরশাদের সময় বহু মানুষ জীবন দিয়েছে।

৯৬ সালে ভোট ও ভাতের অধিকারের আন্দোলনে জীবন দিতে হয়েছে অনেককে। ২০০১ সালের পর আওয়ামী লীগের ২৬ হাজার নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে। গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে। ওয়ান ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনাকে ১১ মাস কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো। অসংখ্য নেতাকর্মী জেলখানায় ছিলো।

বঙ্গবন্ধুসহ পুরো পরিবার হারিয়ে পাহাড় সমান ব্যথা নিয়েও শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষের বেদনার পাহাড় জমিয়ে আছে আওয়ামী লীগে। অসংখ্য মানুষের রক্তের কাছে ঋণী হয়ে আছি আমরা। এমনি এমনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নাই। বহু মানুষের কষ্ট আর বেদনার প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতা মানে দায়িত্ব। ক্ষমতা উপভোগ করার বিষয় নয়। এই কথাটা শেখ হাসিনাই বলেছেন এবং তিনিই সেটা ধারণ করেন। বাকী মানুষ কতটা ধারণ করে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আমরা যারা নতুন প্রজন্ম তাদের এসব ইতিহাস জানা উচিত। তাঁরাও ইচ্ছে করলে পারতেন আমাদের মত সুন্দর জীবন যাপন করতে। ভোগ-বিলাসে জীবন কাটাতে। তাঁরা তা করেননি। জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন দেশের স্বার্থে।

আর এখন তো আমাদের জীবন বিলাতে হচ্ছে না। শুধু একটু ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ করা। পরিবারের সুখের পাশাপাশি পরিজন এবং দেশের মানুষের সুখের চিন্তা করা। দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সামান্য চেষ্টা করা। তবেই এসব মহৎ ব্যক্তিদের আত্মত্যাগ স্বার্থক হবে।

নয়তো এসব মানুষের রক্তের ঋণ, কষ্ট-বেদনা আর অপমানের ঋণে আমরা হারিয়ে যাবো। আওয়ামী লীগ আমাদেরকে কখনোই ক্ষমা করবে না।

লেখক: সদস্য, যুব ও ক্রীড়া উপ কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং
যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ।

01711-944805



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS