ভিডিও

রাজমিস্ত্রি রাজদা’র সংগ্রামী জীবন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৪, ০৬:৩৪ বিকাল
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৪, ০৬:৩৪ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

নাজমুল হাসান, গুরুদাসপুর (নাটোর) : পঞ্চাশ পেরোনো রাজদা বেগম একজন সংগ্রামী নারী। প্রতিবেশীসহ আশে-পাশের সব গ্রামের মানুষ তাকে চিনে ‘রাজমিস্ত্রি রাজদা’ নামে। এক সময় নির্মাণ কাজের জোগালদার হিসেবে কাজ শুরু করলেও এখন তিনি রাজমিস্ত্রি (হেডমিস্ত্রি)। প্রায় ২০ বছর যাবৎ রাজমিস্ত্রির কাজ করে নিজের সংসার চালাচ্ছেন তিনি। বিয়ের পরে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। 

নিজের সংসার চালানোর পাশাপাশি মেয়েকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। বৃদ্ধ মাকে নিজেই বাড়িতে রেখে দেখভাল করছেন। মেয়ে শ্যামলী’র বিয়ের পর বৃদ্ধ মা রাবেয়া বেগমের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব হাসি মুখে নিয়েছেন তিনি। জীবন সংগ্রামী নারী রাজদা বেগমের বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের মশিন্দা কান্দিপাড়া গ্রামে। ওই গ্রামের মৃত-বেল্লাল সরদারের মেয়ে তিনি। নিজ গ্রামসহ আশপাশের অন্তত ২০টি গ্রামে রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন তিনি। 

রাজমিস্ত্রি রাজদা বেগম বলেন, প্রায় ২২ বছর আগে একই এলাকার শাহীন হোসেনের সাথে আমার পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিলো। বিয়ের দুই বছর পার হতে না হতেই আমার গর্ভে ৬ মাসের সন্তান রেখে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায় স্বামী। প্রায় এক মাস অনেক বলার পরেও ভরণ-পোষণ দিতে রাজি হয়নি আমার স্বামী। তখন মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। বাবা’র পরিবারের অবস্থাও বেশি ভাল ছিলো না। বাধ্য হয়ে গর্ভে ৭ মাসের সন্তান নিয়েই রাজমিস্ত্রির (জোগালদার) হিসাবে ২৫টাকা দিনমজুরীতে কাজ শুরু করলাম। মাঝে মাঝে নিজের জীবন অতিষ্ঠ মনে হচ্ছিলো। পেটের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে কষ্ট মেনে নিয়েই শুরু হলো আমার জীবন সংগ্রাম। কাজ করতে করতে আমার মেয়ে সন্তান হলো।

মেয়েকে নিয়েই মানুষের বাড়ি বাড়ি ছুটে যেতাম কাজ করতে। নিজের পরিশ্রমের অর্থেই নিজের সংসার ও মেয়ের পড়াশোনা চলছিলো। দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর আমি রাজমিস্ত্রির(হেডমিস্ত্রি) হয়ে গেলাম। তখন আমার মজুরীও বেশি। হঠাৎ করেই আমার বৃদ্ধ মা রাবেয়া বেগমকেও আমার বাড়িতে আশ্রয় দিতে হলো। কারণ আমার ভাইয়েরা সবাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। তখন মা ও মেয়ের দায়িত্ব আমার কাঁধে পরলো। দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পরিশ্রমও বেড়ে গেলো।

এভাবেই কেটে গেলো ২০ বছর। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ২৫ টাকা দিনমজুরী থেকে এখন আমি পাই ৫০০ টাকা। দশম শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। এখন বৃদ্ধ মা রয়েছে বাড়িতে। বাকি জীবন যতদিন পরিশ্রম করতে পারি ততদিন এভাবেই কাজ করে সংসার চালিয়ে যেতে চাই। অন্যের কাছে সহযোগিতা কখনও চাইতে যাইনি। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন এভাবেই কেটে যাবে জীবন। সরকারি কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘কখনই অন্যের কাছ থেকে সহযোগিতা চাইনি। আর সরকারি কোন সহযোগিতা এখন পর্যন্ত পাইনি।

নির্মাণ শ্রমিক (জোগালদার) আজাদুল প্রামানিং বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ রাজদা বেগমের সাথে কাজ করতেছি। কখনও তাকে কোন কিছু নিয়ে আফসোস করতে দেখিনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক পরিশ্রম করেন তিনি। যা আমরাও পারিনা। আমি তো এখনও জোগালদার হয়েই রইলাম। আর রাজদা বেগম বড় মিস্ত্রি। তার মজুরী ৫০০ টাকা আর আমাদের ৩৫০ টাকা। রাজদা বেগমকে দেখে আমরাও অনেক উৎসাহ পাই। সে নারী হয়ে এতকিছু করতে পারে আমরা কেন পারবো না। আমার নিজের দুই ছেলে এক মেয়ে। কষ্ট হলেও সবাইকে পড়াশোনা করাচ্ছি।’

রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রভাষক মোঃ মাজেম আলী মলিন জানান,‘রাজমিস্ত্রি রাজদা বেগম এই সমাজের অবহেলীত নারীদের উদাহরণ। একজন সংগ্রামী নারী কিভাবে তার জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন তার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে রাজদা বেগমকে দেখে।’

গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা আক্তার জানালেন, খোঁজ খবর নিয়ে রাজদা’র পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে উপজলা প্রশাাসন।

 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS