ভিডিও

‘মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে’ ভরসা রাখল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

প্রকাশিত: মে ০৯, ২০২৪, ০৮:২০ রাত
আপডেট: মে ০৯, ২০২৪, ০৮:২০ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

দুই বছরের বেশি সময় ধরে টালমাটাল ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের জন্য নতুন মডেল ‘ক্রলিং পেগ’ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশ্লেষকদের মতে, এক্ষেত্রে জটিল রোগ সারাতে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে’ই ভরসা রাখল বাংলাদেশ ব্যাংক।

তারা বলছেন, এটি এমন এক ব্যবস্থা যার কোনো সফলতার নজির নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফলাফল পায়নি। সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাবিহীন এই পদ্ধতিকে ক্রলিং পেগ বলতেই নারাজ অর্থনীতিবদরা। অন্যদিকে চার বছরের ব্যর্থ পরীক্ষা শেষে বাজারভিত্তিক সুদহার চালু হয়েছে। এটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করালেও এ ব্যবস্থার সঙ্গে তারা পূর্বপরিচিত।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন  বলেন, ‘ক্রলিং পেগের নামে নতুন যে পদ্ধতি চালু হলো সেটা আসলেই ক্রলিং পেগ কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। আইএমএফ কেন এটাকে ক্রলিং পেগ হিসেবে মেনে নিল তা বোধগম্য নয়। কেননা এখানে ক্রলিং করার কোনো উপায় বলা নেই। এ পদ্ধতি বাজার পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে উল্টো ডলারের জোগান কমিয়ে দেয় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’

 

গতকাল বুধবার ক্রলিং পেগ চালুর মাধ্যমে ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বা‌ড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ব্যবস্থার ফলে দীর্ঘদিন ১১০ টাকায় থাকা ডলারের অফিসিয়াল রেট এক দিনে ১১৭ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এর ফলে ডলারের সঙ্গে টাকার বড় অবমূল্যায়ন করা হলো।

এ পদ্ধতিতে ‘ক্রলিং পেগ মিড-রেট’ (সিপিএমআর) মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। এর সঙ্গে ১ টাকা যোগ কিংবা এক টাকা বিয়োগ করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এর মানে ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১৮ টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলার নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে কেনাবেচা হবে। নতুন পদ্ধতিতে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ডলারের দাম একটা সীমার মধ্যে বাড়বে বা কমবে। এ পদ্ধতিতে চাইলেও ডলারের দাম একবারে অনেক বেশি বাড়তে বা কমতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চসীমা ও নিম্নসীমা নির্ধারণ না করে মধ্যবর্তী সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ডলার লেনদেনের ক্ষেত্রে এ দরের আশপাশে থাকতে বলা হয়েছে।

এ পদ্ধতির ফলস্বরূপ আমরা কী পেতে পারি জানতে চাইলে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ক্রলিং পেগ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ হয়েছে। তবে আমি যতটুকু পড়াশোনা করেছি; এ পদ্ধতির কোনো সফলতার গল্প নেই।’

এতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে আমদানি ও রপ্তানি থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকের কাছে কত দরে ডলার কেনাবেচা করা হবে, তা ঠিক করত বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। এখন থেকে ডলারের দাম নির্ধারণে বাফেদা বা এবিবির কার্যত কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কীভাবে এ পদ্ধতি চালু হবে, তা নিয়ে আইএমএফের শরণাপন্ন হয়। গত মার্চের মধ্যে এ পদ্ধতি চালু করার কথা বলা হলেও মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দিল। আইএমএফের একটি দল গতকাল বাংলাদেশে তাদের সফর শেষ করেছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা। তবে কার্ব মার্কেটে এক ডলার বিক্রি হয়েছে ১১৮ থেকে ১১৮ টাকা ৫০ পয়সায়। নতুন পদ্ধতির কারণে এখন ডলারের দাম একলাফে ১২৪ থেকে ১২৫ টাকা উঠে যাবে বলে অনুমান করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

অন্যদিকে অকেজো হয়ে পড়ায় চালু হওয়ার ১০ মাসের মাথায় ‘স্মার্ট সুদহার পদ্ধতি’ বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে নীতি সুদহার দশমিক ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল একাধিক প্রজ্ঞাপনে এসব সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। তবে এ-সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলন বয়কট করেছেন সাংবাদিকরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেন সাংবাদিকরা। অবিলম্বে সাংবাদিকদের অবাধ তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা না করলে আরও কঠোর আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। 

বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে গতকাল মুদ্রানীতি কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নীতি সুদহার বিদ্যমান শতকরা ৮ শতাংশ থেকে ৫০ সেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে করিডরের ঊর্ধ্বসীমা এবং নিম্নসীমাও বাড়ানো হয়েছে। এ-সংক্রান্ত পরিপত্রে বলা হয়েছে, নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) ক্ষেত্রে সুদহার ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশে এবং নীতি সুদহার করিডরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নীতি সুদহার হলো রেপো। ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদহারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। রেপো রেট বৃদ্ধি করায় ব্যাংকগুলোর অর্থ নেওয়ার খরচ বাড়বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে।

রেপো হার বাড়া মানে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ও ব্যাংকের টাকা ধার করার সুদহার বাড়বে। একই সঙ্গে এর প্রভাবে ব্যাংকে আমানত ও ঋণের সুদহারও বাড়বে। এতে আমানত রাখার পরিমাণ বাড়বে এবং ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমবে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়।

এদিকে দীর্ঘদিন সুদহারের সীমা ৯ শতাংশে বেঁধে রাখার পর গত অর্থবছর থেকে চালু হয়েছিল ‘স্মার্ট রেট’ পদ্ধতি। তবে সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করার লক্ষ্যে অকেজো এ পদ্ধতিটি বাতিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নির্দেশনায় জানিয়েছে, ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদা ও ঋণযোগ্য তহবিলের জোগান সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। তবে ঋণের বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালন করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।

এদিকে বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করায় ব্যাংকের সুদহার বাড়বে। আর সুদহার বাড়লে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং কমে যাবে কর্মসংস্থান। সার্বিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। 

সুদহার বেড়ে গেলে ব্যবসায়ীরা দুর্দশায় পড়বে দাবি করে নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এখন এমনিতেই সুদহার বেশি, এর মধ্যে বাজারভিত্তিক সুদহার হলে এটি আরও বেড়ে যাবে। সুদহার বাড়লে ব্যবসা স্থির হয়ে যাবে। কারণ সবাই একটা হিসাব করে অর্থ নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এখন যদি হিসাবের বাইরে বেশি সুদ দিতে হয়, তাহলে তার খরচ বেড়ে যাবে। বিরাজমান অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে উচ্চ সুদহার যোগ হলে ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে যাবে।’ 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS