ভিডিও

আতঙ্ক না ছড়ানোর আহ্বান

‘তেড়ে কামড়ায় না ‘রাসেলস ভাইপার’

সাপ ধরতে রয়েছে স্নেক রেসকিউ টিম

প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২৪, ১০:০৯ রাত
আপডেট: জুন ২২, ২০২৪, ০১:৫৩ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

করতোয়া ডেস্ক : রাজশাহীর গোদাগাড়ি এলাকায় এখন মাঠভর্তি পাকা ফসল। কিন্তু কৃষকের মনে আতঙ্ক। একদিকে বৃষ্টি, আরেক দিকে মুখে মুখে ‘রাসেলস ভাইপারের’ (চন্দ্রবোড়া সাপ) কথা শোনা যাচ্ছে। পাশের কয়েকটি গ্রামের বসতভিটাতেও নাকি গাদা গাদা দেখা যাচ্ছে। কাঁকন হাটের এক কৃষককে জিজ্ঞেস করা হয়Ñদেখেছেন নাকি রাসেলস ভাইপার সাপ? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি দেখিনি, কিন্তু আমার ভায়রা ভাই দেখেছে। সেই ভায়রা ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সাপটা একটু অন্যরকম দেখতে। এই সাপকে আমরা ‘চন্দ্রবোড়া’ বলি। কিন্তু আমি শিওর না। এলাকার লোক মেরে ফেলার পরে আমি শুনেছি।’

গণমাধ্যমের বরাতে রাসেলস ভাইপার এখন পরিচিত নাম। এটা একটা প্রায় বিলুপ্ত বিষধর সাপ, যা হঠাৎই বংশবিস্তার শুরু করেছে বলে নিত্যদিনের খবরে জানা যাচ্ছে। কিন্তু প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, আগে নিশ্চিত করে জানুন আসলেই রাসেলস ভাইপার এভাবে ধেয়ে আসছে চারপাশে, নাকি কানে কানে শুনে শুনে ছড়িয়ে পড়ছে। এলাকাভিত্তিক খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একদিকে আতঙ্কে মাঠে যেতে ভয় পাচ্ছেন কৃষক, আরেকদিকে যেখানে সাপ দেখা যাচ্ছে, তার জাত না জেনেই মেরে ফেলা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে সতর্ক থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলছেন প্রাণিবিজ্ঞানীরা। তবে, ইতোমধ্যে কৃষকদের ভয় দূর করতে হাঁটু পর্যন্ত বুট পরার পরামর্শ দেওয়া থেকে শুরু করে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।

এদিকে পরিবেশবাদীরা বলছেন, সাপের অ্যান্টিভেনম যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মৃত্যু ঠেকানো যাবে। এই সাপ বিষধর কিন্তু তেড়ে এসে কাউকে কামড়ায় না। সতর্ক থাকলে সাপও বাঁচবে, মানুষও বাঁচবে। না বুঝে সব সাপ মেরে ফেললে বাস্তুসংস্থানের ওপর চাপ পড়বে। সেটা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসার জন্য যে সাপে কামড়াবেÑতার অ্যান্টিভেনম দরকার হবে। সেটাই সবচেয়ে কার্যকর হয়। ভারতে যেসব সাপ থেকে ভেনম সংগ্রহ করা হয়, সেগুলোর মাত্র ২০ শতাংশ বাংলাদেশের সাপের সঙ্গে মেলে। সুতরাং, সেই সাপ থেকে প্রস্তুত অ্যান্টিভেনম (ভারতীয়) এই সাপের কামড়ের চিকিৎসায় শতভাগ কাজ করবে না।

এই সাপ নিয়ে আতঙ্ক না ছড়িয়ে করণীয় কী জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, ‘‘এটা বিষধর সাপ। এরা সাধারণত কৃষি জমিতে ইঁদুর, ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ অন্যান্য প্রাণী খেয়ে থাকে। না চিনে ভীতি থেকে যেনতেন সাপ মেরে ফেললে খাদ্য-শিকলে প্রভাব পড়বে। সাধারণত সব সাপ ইঁদুর খায় না, এরা খায়। ইঁদুর বেড়ে গেলে সেটা জীবনযাত্রাকে কী পরিমাণ ব্যাহত করবে, তার ধারণাও আমাদের নেই। ফলে গণমাধ্যমে আতঙ্ক না ছড়িয়ে, এই সময়ে সচেতনতামূলক কথাবার্তা যেন বলা হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমত, চেনানো দরকার সাপটা দেখতে কেমন। এটার সঙ্গে অজগর, স্যান্ডবোয়ারের মিল আছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই গায়ের গোল গোল রিংয়ের ভিন্নতা চোখে পড়বে। রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার গায়ে চাকা গোল গোল চিহ্নগুলো আলাদা আলাদা। অজগরের চাকা গোল, গোলগুলো নেটের মতো, একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। চিনে রাখুন, ভয়ের কিছু নেই্। এই সাপ দৌড়ে তাড়া করে না, বাসায় এসে কামড়াবে না। আর কর্তৃপক্ষের জায়গা থেকে বৈজ্ঞানিক সার্ভে করা যেতে পারে। আসলে কী পরিমাণ বেড়েছে। আমাদের এখানে সাপ ধরার ব্যবস্থা আছে। এই সাপের চাহিদা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশে আছে। সেগুলোতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এদের ‘ভেনম’ খুব দামি। সেটাও আমরা বিবেচনায় নিয়ে ভেনম রিসার্চ সেন্টারকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা নিতে পারি।’’

এই সাপ কি হঠাৎই বেড়ে গেলো প্রশ্নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নঈম গওহার ওয়ারা বলেন, ‘২০০০ সালের আগে তেমন একটা দেখা যেতো না। এটা বন্যার মাধ্যমে ভারত থেকে এসে থাকতে পারে। এই মুহূর্তে সাপের পরিমাণ নির্ধারণ ও অ্যান্টিভেনম নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বল্প সংখ্যক রাসেলস ভাইপার সবসময়ই ছিল। কিন্তু বংশবিস্তারের মতো পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাদ্য বেড়ে যাওয়ায়, পদ্মা অববাহিকার মাধ্যমে সেই বেল্ট ধরে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর জন্য একই জমিতে বছরে তিন ফসল উৎপাদনও অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

রাসেলস ভাইপার সাপ দেখলে স্নেক রেসকিউ টিমকে জানান : রাসেলস ভাইপার সাপ দেখা গেলে আতঙ্কিত না হয়ে ‘স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশ’কে জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন টিমের রেসকিউয়ার এবং সভাপতি মো. রাজু আহমেদ। শুক্রবার  সকাল থেকে ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন একটি বার্তা সবাই শেয়ার করছেন। যোগাযোগের ফোন নম্বর ০১৭৮০৯৩২৭১৭ উল্লেখ করে সেখানে বলা হয়েছে, রাসেলস ভাইপার সাপ দেখা গেলে স্নেক রেসকিউ টিমকে জানালে বিনামূল্যে সাপ উদ্ধার করে আপনাকে বিপদ মুক্ত করবে।

ঢাকা আসার সম্ভাবনা নেই : মো. রাজু আহমেদ আরও বলেন, রাসেল’স ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ রাজধানী ঢাকায় আসার সম্ভাবনা নেই। কেননা এই সাপ মূলত পদ্মা নদী কেন্দ্রিক থাকে। তারা পদ্মা নদীর এক-দুই কিলোমিটারের বেশি যায় না। এবং এই সাপ নদী দিয়ে চলাচল করে থাকে। অনেকে ফেসবুকে শেয়ার করছে। রাসেলস ভাইপার ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় দেখা যাচ্ছে। এটা ভুল তথ্য। পদ্মা নদীকেন্দ্রিক রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জসহ নদী ঘেঁষা এসব জেলায় এ সাপ দেখা গেলেও পুরো জেলা পাওয়া যাবে না। শুধু মাত্র পদ্মানদীর এক-দুই কিলোমিটারের মধ্যে রাসেলস ভাইপার সাপ থাকে।

যে কারণে গরমে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায় : গ্রীষ্মকাল আসতেই বেড়ে যায় গরমের প্রকোপ। তীব্র গরমে নাজেহাল হয়ে যায় জনজীবন। আর গরমের সময়ে বেড়ে যায় সাপের উপদ্রব। দাবদাহে বিষাক্ত সাপও সক্রিয় হয়ে ওঠে। 

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ডিপার্টমেন্ট অব পার্কস এন্ড ওয়াইল্ড-লাইফ বলছে, সাপ হচ্ছে ঠান্ডা রক্তের প্রাণী। সাপ তীব্র ঠান্ডাও সহ্য পারেনা। তখন তারা হাইবারনেশনে চলে যায় গর্তের ভেতরে। অন্যদিকে, তীব্র গরমও এড়িয়ে চলে সাপ। তাপমাত্রা যখন তীব্র হয় তখন সাপ খুব ভোরে, সন্ধ্যায় এবং রাতে চলাচল করে। তখন তারা খাবারের জন্য সক্রিয় হয়। গবেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত গরমের সময় সাপ ছায়া, অন্ধকার, আর্দ্রতা ও খাবার খোঁজে। সাপ নিজেকে ঠান্ডা রাখার জন্য আর্দ্র পরিবেশ খোঁজে। সেজন্য অনেক সময় তারা মানুষের ঘরের আশপাশে চলে আসতে পারে। যে সব বাসায় এ ধরনের পরিবেশ থাকে সেখানে সাপের আনাগোনা হতে পারে। এ ধরনের পরিবেশ না থাকলে সেখানে সাপ আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সাপ খোলামেলা জায়গায় এবং উন্মুক্ত অবস্থানে থাকতে খুবই অপছন্দ করে।

ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে রাসেল ভাইপারের গুজব : দেশের বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়ায় দেশব্যাপী আলোচনায় বিষধর সাপ চন্দ্রবোড়া বা রাসেল ভাইপার। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সাপের বিষক্রিয়া নিয়ে চলছে আলোচনা। কিন্তু সাপটি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফেসবুকে শুরু হয়েছে গুজব। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে স্থানীয় কয়েকটি ফেসবুক ভিত্তিক গ্রুপে শহরের পুনিয়াউটসহ কিছু এলাকায় রাসেল ভাইপার সাপ পাওয়ার পোস্ট দেওয়া হয়। এসব পোস্ট দ্রুত ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট আইডি থেকে ছড়িয়ে পরে। ফেসবুকে এসব ছবি ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরে যাচাই করে জানা যায় এসব ছবি অন্য জেলার। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জেলার কোথাও রাসেল ভাইপার উদ্ধার কিংবা এর কামড়ে কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এ খবর নিশ্চিত করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন।

 

 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS