ভিডিও

অনিয়মের আখরায় পরিণত হয়েছে বগুড়ার সারিয়াকান্দি হাসপাতাল

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ০১, ২০২৪, ১০:১৮ রাত
আপডেট: সেপ্টেম্বর ০১, ২০২৪, ১০:২০ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

সারিয়াকান্দি (বগুড়া) প্রতিনিধি : অনিয়ম আর দুর্নীতির আখরায় পরিণত হয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট বগুড়া সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। রোগীদের চিকিৎসা সেবার ঘাটতি, ওষুধ সরবরাহে অনিয়ম, পরীক্ষা নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি কয়েকযুগ ধরে তালাবদ্ধ, কোটি টাকার অপারেশন থিয়েটার শুরু থেকেই তালাবদ্ধ, রোগীদের নিম্নমানের খাবার পরিবেশনসহ নানা অনিয়মের আখরায় পরিণত হয়েছে এই হাসপাতালটি।

হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পরে ওষুধ কোম্পানির একদল প্রতিনিধি দাঁড়িয়ে আছেন সারিবদ্ধভাবে। মাছ শিকারের মতো রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলতে তারা ক্যামেরা নিয়ে ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকেন। রোগী এলেই তার ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলতে তারা প্রতিযোগিতা শুরু করেন এবং ছবি তুলেন।

এছাড়া রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেখা জানা যায়, হাসপাতালের ডাক্তারের লিখিত ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ তাদের হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়নি। নামে মাত্র দু একটি ওষুধ দিয়ে অবশিষ্ট ওষুধগুলো বাইরে থেকে কিনতে বলা হয় এবং সেগুলোতে টিক চিহ্ন দেয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ হাসপাতালে প্রতিদিন মাত্র ২ গ্রুপের এন্টিবায়োটিক সরবরাহ করা হয়।

সেগুলো হলো সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং এমোক্সিসিলিন। রোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় বেশিরভাগ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে এজিথ্রোমাইসিন নামক এন্টিবায়োটিক লিখে দেয়া হয়। কিন্তু তা হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়না, যা প্রতি ট্যাবলেটের মূল্য ৩৫ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা পর্যন্ত।

সরেজমিন পরিদর্শন করে হাসপাতালের নোংরা পরিবেশে একেবারেই লক্ষ্যণীয়। এ হাসপাতালের রোগীদের থাকার কক্ষের বেশকিছু ফ্যান এবং লাইট নষ্ট। হাসপাতালের জেনারেটর প্রায় একযুগের বেশি সময় ধরেই নষ্ট। ফলে বিদ্যুৎ না থাকলে রোগীরা গরমে মানবেতর জীবনযাপন করেন।

একেবারেই দুস্থ এবং যাদের অন্যত্র চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ্য নেই, তারাই শুধুমাত্র বাধ্য হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েও ক্যানোলা, বেশকিছু স্যালাইন এবং প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ দামি ওষুধ বাইরের ডিসপেনসারি থেকে কিনতে হচ্ছে। হাসপাতালের ভর্তি রোগীদের রুমে ঢুকতেই চোখে পরে বেডের নোংরা পরিবেশ। সেখানকার পরিবেশ এবং দুর্গন্ধে সুস্থ মানুষের বমি আসে।

তাই বেশিরভাগ নিকটস্থ রোগীরা সারাদিন চিকিৎসা গ্রহণ করে রাতে নিজেদের বাসায় গিয়ে রাত্রি যাপন করেন। এদিকে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হাসপাতালের কোয়ার্টারে গিয়ে দেখা যায় সেখানে শুনসান নিরবতা বিরাজ করছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ হাসপাতালের রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসক সংখ্যা ১৩ জন। তাদের মধ্যে মাত্র ৫ জন চিকিৎসক হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকেন।

তারা হলেন, ডা: উম্মে হাবিবা বাসেদ, ডা: ফাহমিদুল হাসান পিয়াস, ডা: মাশকুরুর মোকাররম জিম, ডা: জান্নাতুল ফেরদৌস, ডা: তানজিল আহমেদ এবং ডা: সুবির মজুমদার। আর বাকি সব ডাক্তার বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকে এ হাসপাতালে যাতায়াত করেন। তাই চিকিৎসকদের নিকট থেকে ভাল চিকিৎসাসেবা পান না বলে জানিয়েছেন একাধিক এলাকাবাসী। হাসপালটির জরুরি বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীরা।

একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ জরুরি বিভাগ থেকে গুরুতর অবস্থা না হলেও বগুড়ায় চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় রোগীদের। বহির্বিভাগে রোগীরা সকাল ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা পান। ১২ টার পর থেকেই হাসপাতালে কোন চিকিৎসক পাওয়া যায় না। একাধিক রোগীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই হাসপাতালে ক্রনিক ডিজিসের রোগীরা তাদের কাঙ্খিত ওষুধ দীর্ঘদিন থেকে পাচ্ছেন না। ডায়াবেটিস, প্রেসার এবং হার্টের ওষুধ গরীব রোগীদের বাইরে ডিসপেনসারি হতে কিনতে হচ্ছে।

যেসব ওষুধ হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে তা ডাক্তারের প্রেসক্রিপসনের সাথে কাঙ্খিত ওষুধ মিলছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ হাসপাতালের এক্সরে মেশিনসহ বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মেশিন কয়েকযুগ ধরেই নষ্ট। বিভিন্ন ধরনের টেস্ট রোগীদের প্রায় একযুগ আগে থেকেই বাহিরের ডায়াগনস্টিক থেকে করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষাগুলোও বাইরে থেকে করতে হয়। অথচ অপারেশন থিয়েটারসহ কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি তালাবদ্ধ রয়েছে।

ফলে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি ডায়াগনষ্টিকের ব্যবসা এখন রমরমা। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে প্রতিদিন নিম্ন মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। প্রতিদিন সকালে ১ টি ৫ টাকা মূল্যের পাউরুটি ২ টি সাগর কলা ১ টি ডিম এবং দুপুর ও রাতে অত্যাধিক পানির ঝোল মিশ্রিত স্বাদবিহীন ঘাটি খেতে দেয়া হয় রোগীদের।

হাসপাতালের একজন নির্ভরযোগ্য কর্মচারী জানিয়েছেন, এ হাসপাতালের কয়েকজন ক্লিনার এবং নিম্ন পদস্থ কর্মচারী হাসপাতালে ডিউটি করেন না। তারা ভাড়া করা লোক দিয়ে হাসপাতালে ডিউটি করান। হাসপাতালের হাজিরা খাতায় যাদের নাম রয়েছে তারা আসলে প্রকৃতপক্ষে হাসপাতালেই আসেন না।

উপজেলার হাটফুলবাড়ী ইউনিয়নের কাটাখালি গ্রামের রুবিনা বেগমের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসী বলেন, গতকাল শনিবার হাসপাতাল ভর্তি হয়েছি। হাসপাতালের নোংরা পরিবেশে থাকতে পারলাম না। সকালে বাইরে থেকে ইনজেকশন কিনে আমাকে দেয়া হয়েছে। তাই ছুটি নিয়ে আজ বাড়ি যাচ্ছি।

সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মাহবুব হাসান সরদারের সাথে গতকাল শনিবার হাসপাতালে দেখা করতে গেলে তাকে হাসপাতালে অনুপস্থিত পাওয়া যায়। রবিবার দুপুর ১ টার দিকে তার সাথে কথা বলতে গেলে তাকে হাসপাতাল পাওয়া যায়নি।

পরে মুঠোফোনে তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এতক্ষণ হাসপাতাল ছিলাম। শরীরটা খুবই অসুস্থ অনুভব করায় হাসপাতাল থেকে বাইরে এসেছি। আপনি হাসপাতালের সমস্যা নিয়ে আমার সাথে সরাসরি কথা বলুন’।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS