ভিডিও

তদন্ত কমিটির কার্যক্রম চলছে

বগুড়া রথযাত্রায় দুর্ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অপরিণামদর্শীতার অভিযোগ

প্রকাশিত: জুলাই ১১, ২০২৪, ১০:০৯ রাত
আপডেট: জুলাই ১২, ২০২৪, ০২:০১ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

স্টাফ রিপোর্টার : গত রোববার বগুড়ায় রথাযাত্রায় বিদ্যুৎস্পর্শে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি তাদের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করেছে। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে এর তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা মাথায় রেখে এই কমিটি আগামী সপ্তাহের মধ্যেই তাদের তদন্ত কাজ শেষ করবেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। এদিকে পারিপার্শিক অবস্থা বিবেচনার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় পর্যালোচনা করে এ ঘটনার জন্য আয়োজকদের দায়িত্বে অবহেলা, সমন্বয়হীনতা সর্বোপরি রথ হিসেবে ব্যবহার করা যানটি ত্রুটিপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

বগুড়ায় ইসকন পরিচালিত ওই রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে পাঁচজনের মৃত্যু ও প্রায় অর্ধশত আহত হওয়ার ঘটনাটি তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পিএম ইমরুল কায়েসকে প্রধান করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, নেসকো ও সিভিল সার্জনের প্রতিনিধির সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করেছে। এ ব্যাপারে গতকাল কমিটি প্রধান জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তারা ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বেশ কয়েকজন আহত ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী ও আয়োজকদের সাথে কথা বলেছেন, সর্বোপরি যে রথে এই দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে তা পর্যবেক্ষণ করে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

এদিকে ১৯ বছর ধরে ইসকনের পক্ষ থেকে এই রথযাত্রার আয়োজন করা হলেও এবারই সবচে’ বেশি অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। প্রথমত, রথযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে প্রতিবারই পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টিান ঐক্যপরিষদসহ স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ইসকন কর্তৃপক্ষ বৈঠক করেন। কিন্তু এবার তারা কারও সাথেই বৈঠক করা তো দূরের কথা কারও সাথেই কথা বলেননি। এমন কি, রথযাত্রার দিন যে পুলিশ লাইন মন্দিরে রথটি রাখা হযেছে, যা উল্টোরথ পর্যন্ত সেখানে থাকবে সেই মন্দির কমিটির সাথেও এবার বৈঠক হয়নি। মন্দির কমিটির সম্পাদক বরুণ কুমার রায় বলেন, প্রতি বছর ইসকন তাদের সাথে বৈঠক করে নানা কর্মপন্থা নির্ধারণ করে। তাদের মন্দিরের নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৪০জন যুবক রয়েছে, যারা ইতোপূর্বে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছে, এবার ইসকেনর পক্ষ থেকে তাদেরকে সে কাজে লাগানো হয়নি। তেমনিভাবে অন্যান্য সংগঠনেরও শতাধিত কর্মী রয়েছে, যারা প্রতিবারই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে। এবার তারাও ছিল অনুপস্থিত।

তা ছাড়া রথ নিয়ন্ত্রণের জন্য এর সামনে লাল ও সবুজ পতাকা হাতে দু’জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করতো, এবার পতাকা হাতে কাউকে দেখা যায়নি।

সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত রথ নামক যানটির অকার্যকারিতা এবার স্পষ্ট হয়েছে। ২০০৬ সালে পিন্টু দত্ত নামের একজন ব্যবসায়ী রথটি উপহার হিসেবে দান করেন। সে সময় উৎসবে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ও রাস্তাঘাট বিবেচনায় সর্বোপরি সে সময়কার উচ্চতায় কোন সমস্য হয়নি। কিন্তু দিন বাড়ার সাথে সাথে এই রথের উচ্চতা বাড়ানো হলেও এটি সময়োপযোগী করার ব্যাপারে কোন উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।

প্রাচীন এ উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ব্রহ্ম পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ ও কপিলা সংহিতায়। ১৩শ’ শতাব্দী থেকে ইউরোপীয় পর্যটকদের দ্বারা উৎসবের রেকর্ডগুলোতেও এর উল্লেখ আছে। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরীতে শ্রীশ্রী জহন্নাথ দেবের এই রথযাত্রার গোটা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষভাবে পূজিত হয়ে আসছে। সেখানে তিনটি রথের মাধ্যমে এই উৎসব হয়। এর মধ্যে জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ বহনকারী রথটি সর্বোচ্চ এবং এর উচ্চতা ৪৪ ফুট ২ ইঞ্চি। বিশেষ কাঠের তৈরি এই রথের রয়েছে ১৬টি চাকা। এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ৩৮ ফুট ৬ ইঞ্চি করে। জগন্নাথ মন্দির থেকে গন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত গ্র্যান্ড রোডের ৩ কিলোমিটার পথটি প্রায় আড়াই শ’ ফুট প্রশস্ত। তা ছাড়া এই রাস্তার উপর দিয়ে বৈদ্যুতিক তারও নেই। কিন্তু বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি এলাকায় রাস্তার যে অংশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে রাস্তা ২৫ ফুটের বেশি নয়। তা ছাড়া এই রথের উচ্চতা ধাতব শলাকা সংযুক্ত পতাকাস্ট্যান্ডসহ মোট ৪০ ফুট বলে বগুড়া ইসকনের অধ্যক্ষ খরাজিতা ব্রহ্মচারী নিজেই বলেছেন। তবে এই রথের প্রকৃত উচ্চতা ৩২ ফুট বলেও বলা হয় তাদের পক্ষ থেকে।

সম্পূর্ণ ধাতব নির্মিত এই রথে রয়েছে মাত্র চারটি চাকা এবং তাও প্রয়োজনীয় মাপে চওড়া নয়।  যেভাবে এটি পরিচালনা করা হয়, তা কোনভাবেই নিরাপদ নয়। কারণ চূড়া উঠানো নামানোর যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেটি ম্যানুয়ালি তৈরি। একটি হুইলের সাথে দু’টি পেনিয়াম যুক্ত করে আয়রন রোপের মাধ্যমে এটি করা হয়। দেখা গেছে, প্রধান পেনিয়ামের সাথে একটি লক আছে। ধারণা করা হচ্ছে এই লকটা শেষ মুূহূর্তে কাজ না করায় চূড়াটি নামতে পারেনি। আর এ কারণে তা ১ কেভি সঞ্চালন লাইনের সংস্পর্শে এসে বিদ্যুতায়িত হয়ে এই ভয়াবহ হতাহতের ঘটনা ঘটে।

সব জায়গায় কাঠের তৈরি রথ ব্যবহার করা হলেও ইসকনের রথ ধাতব বস্তু দিয়ে তৈরির বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন সকলের। কারণ গত বছর ভারতের ত্রিপুরায় ইসকনেরই ধাতব রথে হাইভোল্টেজের তারের সংস্পশ্যে এসে ৭জন মারা গেছে। এরপরই শিক্ষা নিয়ে অন্তত বগুড়ায় বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত ছিল কারণ গত বছর বগুড়া সদর থানার সামনে ইসকনের রথের চূড়ায় বৈদ্যুতিক তার স্পর্শ করলেও ভাগ্যক্রমে তখন বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটেনি। এ কারণে পূর্বাহ্নেই বগুড়া সদর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) বগুড়া ইসকনের অধ্যক্ষকে রথের চূড়া উঁচু না করার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তা শোনেননি।

সর্বোপরি কর্তপক্ষের একগুঁয়েমি, অনেকক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতায় এই মর্মন্তুদ হতাহতের ঘটনা ঘটলো। বিশিষে করে গত বুধবার ইসকনের নেতৃবৃন্দ যখন সারিয়াকান্দির এ ঘটনায় নিহত সন্ধ্যা রাণরি বাড়িতে যান, তখন তার মেয়ে বিলাপ করতে করতে তাদের কাছে অনুযোগের সুরে বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে, এখন আপনাদের একটা ভুলে আমরা মাকেও হারালাম।’



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS