ভিডিও

বগুড়ার ইসকন’র রথযাত্রা ট্রাজেডিতে ৭ মৃত্যুর পর অঙ্গহানি ৩ জনের

আহতদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে

প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৪, ০৯:৪২ রাত
আপডেট: জুলাই ৩০, ২০২৪, ০৯:৪৮ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

স্টাফ রিপোর্টার : বগুড়া শহরের সেউজগাড়িতে অবস্থিত ইসকন আনন্দ আশ্রমের উদ্যোগে বের হওয়া রথযাত্রায় বিদ্যুতায়িত হয়ে গুরুতর আহতরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। গুরুতর আহতদের মধ্যে ১৫ জন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ও দুইজন ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এদের মধ্যে ক্ষত স্থানে ইনফেকশন দেখা দেওয়ায় শরীরীর অংশ বিশেষ কেটে ফেলতে হয়েছে। আরও কয়েকজনের অঙ্গহানী হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে এ ঘটনায় কয়েকজনকে পঙ্গুত্ব বরণ করে বা  প্রতিবন্ধী হয়ে আজীবন বেঁচে থাকতে হবে।

এদিকে দীর্ঘ প্রায় ২৩ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের দেখাশোনা ও অন্যান্য যোগান দিতে গিয়ে সংসারের আয় রোজগার বন্ধ হওয়ায় অনেক পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আবার কেউবা গরু বা অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করে এবং সুদের উপর টাকা ধার নিয়েও খরচ নির্বাহ করছেন।

গত ৭ জুলাই বগুড়া ইসকন আনন্দ আশ্রমের আয়োজনে বে’র হওয়া রথযাত্রার রথের সাথে বিদ্যুতের তারের স্পর্শে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ৫ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হন। গুরুতর আহতদের উদ্ধার করে বগুড়া শজিমেক ও মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই রাতেই উন্নত চিকিৎসার জন্য দুই জনকে ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউটে স্থানান্তর করা হয়।

পরে ওই দুইজনও মারা যান। এ ছাড়া আরও দুইজনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। তারা বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বগুড়া সদরের মগলিশপুর গ্রামের বাবু চন্দ্র মোহন্তর স্ত্রী আলো রাণী মোহন্ত (৪০) রথযাত্রায় বিদ্যুতায়িত হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘ সময় চিকিৎসাকালে ইতিমধ্যে তার বাম পায়ের পাতা কেটে বাদ দিতে হয়েছে।

তার ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের গোড়ালির উপর পর্যন্ত পুড়ে গেছে। আলো রাণীর স্বামী রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। স্ত্রী, মেয়ে ও নাতনী আহত হওয়ায় বেশ কয়েকদিন তিনি রোজগার করতে পারেননি। এতে তিনি ধার-দেনার মধ্যে পড়েছেন।

তার স্ত্রী সুস্থ হতে আরো কতদিন লাগবে এনিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এ ঘটনায় আলো রাণী মোহন্ত’র মেয়ে পূজা মোহন্ত ও তার শিশু কণ্যা তূর্ণ (আড়াই বছর) আহত হয়ে ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছে।

শহরের চেলোপাড়া এলাকার পবন চন্দ্র দাসের স্ত্রী পূরবী রাণী’র(৫০) ডান হাতের কণুই এর নিচে ও উপরের দিকে পুড়ে গেছে। এছাড়া তার কোমড়ের ডানপাশের পিছনের অংশও পুড়ে যায়। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের ফণি সরকারের স্ত্রী গীতা রাণী সরকারের (৪৫) ডান হাতের পুরোটাই পুড়ে গেছে। তার বাম পায়ে ৫টি আঙ্গুল কেটে বাদ দিতে হয়েছে।

এ ছাড়াও তার পিঠের ডান পাশে পুড়ে গেলেও তাকে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হচ্ছে। তার স্বামী ফুটপাতে চা বিক্রি করেন এবং তার সাথে স্ত্রী দর্জির কাজ করে কোনমতে সংসার চালিয়ে আসছিলেন। দীর্ঘদিন যাবৎ তাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিচিতজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসারে যোগান দিয়ে যাচ্ছেন।

ফলে তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। শহরের চকসুত্রাপুর এলাকার মহেশ বাঁশফোড়ের স্ত্রী শান্তি রাণী বাঁশফোড় (৪০) এর উরু থেকে পা পর্যন্ত পুড়ে গেছে। ডান হাতের কনুইও পুড়েছে। বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুর এলাকার রূপলাল দাসের স্ত্রী চান মনি দাস (৫৫) এর কোমড়ের নিচে বাম পাশের মাংস পুড়ে যাওয়ায় সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সুশীল চন্দ্রর স্ত্রী জোৎস্না বালা’র ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের গোড়ালির উপর পর্যন্ত পুড়ে গেছে। তার গলার মাংসও পুড়ে যাওয়ায় সেখানে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। একই উপজেলার পূর্ব বানীহালী বৈরাগীর হাট এলাকার অজিত পালের স্ত্রী জোস্না রাণী পালের (৪০) বাম পায়ের মাঝের ৩টি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়েছে।

তার বাম উরু ও পেটের ডান পাশের মাংস পুড়ে গেছে। এ ছাড়াও তার দু’টি পা ঝলসে গেছে। জোস্না বালা পালের বড় ছেলে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র সবুজ কুমার পাল জানান, তার বাবা মাটির তৈজষপত্র তৈরি করে সংসার পরিচালনা করে থাকেন। তার ছোট ভাই বেগম রোকেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ছাত্র।

তার মা’র এ অবস্থায় তার বাবার আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন যাবৎ হাসপাতালের খরচের যোগান দিতে গিয়ে তাদের একটি গরু বিক্রি করতে হয়েছে। তিনি আরও জানান, হাসপাতালে যে ওষুধ সরবরাহ আছে সেগুলো দেয়া হয়। এ ছাড়াও অন্যান্য জিনিসপত্র, হাসপাতালে যাতায়াত এবং তাদের খাওয়া খরচ বাবদ প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার টাকা যোগান দিতে হয়। তবে ইসকন থেকে তাদের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

এদিকে ঘটনার দিন নিহত বগুড়া শহরের পুরানবগুড়া এলাকার আতোশী রাণী ও লংকেশ্বর সরকারের মেয়ে রুমকী’র (৯) অবস্থাও ভাল নয়। রাজমিস্ত্রির যোগালদার লংকেশ্বর সরকার জানান, কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর তার মেয়েকে নিয়ে এসে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করেছেন।

মেয়েটির দুই পা ও ডান হাত পুড়ে গেছে। ইতিমধ্যে তার হাসপাতালের বিল ১৭ হাজার টাকা উঠেছে। পুরানবগুড়া এলাকায় পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দেড় শতাংশ জমির উপর টিনশেড ঘর করে থাকেন। এ ছাড়া তার আর কোন সম্পদ নেই। মেয়ের চিকিৎসায় সময় দিতে গিয়ে কাজকর্ম করতে না পারায় তিনি ধার দেনার মধ্যে পড়েছেন।

আনন্দ আশ্রম পরিচালনা কমিটির সভাপতি দিলীপ কুমার দেব জানান, দুর্ঘটনার পর ইসকন কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের পরিবারে যথাসাধ্য সহায়তা দিয়েছেন। এখনো হাসপাতালে ভর্তিকৃতদের তিন বেলা খাবারের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সহায়তার জন্য প্রশাসনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।

বগুড়া ইসকন আনন্দ আশ্রমের অধ্যক্ষ খরাজিতা কৃষ্ণ দাস জানান, দুর্ঘটনার পর থেকে আশ্রম থেকে নিহত ও আহতদের সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এখনো সহায়তা প্রদান করে চলেছেন। নিহতদের পরিবারে ১ লাখ টাকা করে এবং গুরুতর আহতদের পরিবারে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

এরপরও অনেকে এসে সহায়তা নিয়ে গেছেন। তাদেরকে প্রতিদিন তিনবেলা করে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। আহতদের পরবর্তীতে আর কোন সহায়তা প্রদান করা হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইসকন বাংলাদেশ (কেন্দ্রীয় কমিটি)র বৈঠক ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। খুব শীঘ্রই ওই কমিটির নেতৃবৃন্দ বগুড়ায় আসবেন সার্বিক দিক পর্যালোচনা করতে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী আগামীতেও সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে।

বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. মো: আব্দুল ওয়াদুদ জানান, সাধারণত বার্ণ’র রোগীদের দীর্ঘদিন চিকিৎসা প্রদান করতে হয়। আর রোগীরা দ্রুত সেরে উঠতে চায়। এ কারণে অনেকেই হাসপাতাল থেকে চলে যায়।

পরে পোড়া অংশ জটিল আকার ধারণ করলে আবারো হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়। ভর্তিকৃত রোগীদের একাধিকবার অপারেশন করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব সময় রোগীদের গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করে থাকে।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS