ভিডিও

ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়াতে হবে

আব্দুল হাই রঞ্জু

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৪, ০৮:০০ রাত
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৪, ০৮:০০ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

বৈশ্বিক মহামারি করোনার ছোবলের পর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, মানুষের স্বাভাবিক রুটি-রুজির দুরবস্থা এখনও অনেকাংশেই বিদ্যমান। এরই মাঝে ভোজ্য তেলের উপর্যুপরি মূল্যবৃদ্ধিসহ কম-বেশি সকল নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে আজ বিপর্যস্ত জনজীবন। দাম কমার কোন সুবাতাস তো নেই, উল্টো দিন দিন সবধরনের নিত্য পণ্যের দাম বেড়েই চলছে।

ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে কিছু দিন আগে ‘বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যাসোসিয়েশন’ সয়াবিন ও পামঅয়েলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা করেন সংবাদ সম্মেলন করে। সংগঠনটি দাবি করেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের বাজার বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করার কারণে মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে।

এটাও সত্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বেই সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার, পামঅয়েলের উপর বিরুপ প্রভাব পড়েছে। অতিসম্প্রতি পামঅয়েলের প্রধান উৎপাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া পামঅয়েল রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় এ সংকট আরো তীব্র হয়েছে। সে অজুহাতে ভোজ্যতেলের বাজার অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ানো হয়েছে।

বাস্তবে আমাদের দেশে কোন না কোন অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ে। আর একবার দাম বাড়লে তা আর কমে না। আর সেই সুযোগ একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধ ভাবে পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোক্তার গলা কাটে। এটা যে শুধু ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে তা নয়, প্রায় সবক্ষেত্রেই এ ধরনের অপকৌশলের সুযোগ নেয়া হয়। তবে কিছুদিন ধরে ভোজ্যতেলের অস্থির বাজার জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুললেও সম্প্রতি দাম কিছুটা কমেছে।

আর এভাবেই হাতে গোনা ক’টি শিল্প গ্রুপ সাধারণ ভোক্তার পকেট কেটে ফুঁলে ফেঁপে আরো কলাগাছ হচ্ছে। দেখুন, সয়াবিন তেল, পামঅয়েল আমদানি করা কিন্তু বন্ধ নেই। ভোজ্যতেল পূর্বের দরে আমদানি অব্যাহত রয়েছে। আমদানিকৃত এসব ভোজ্যতেল দেশে আসার পর রিফাইন করে বর্তমানের বাড়তি দরে আমদানিকারকগণ বিক্রি করেন।

ফলে লিটার প্রতি বেশি দামে সয়াবিন ও পামঅয়েল বিক্রি করলে কি পরিমাণ লাভবান হবেন, যা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বন্দর সুত্রে জানা গেছে, কিছুদিন আগে ‘এমভি ওরিয়েন্ট চ্যালেঞ্জ’ নামে একটি জাহাজ সিঙ্গাপুর থেকে ২ কোটি ২৯ লাখ লিটার অপরিশোধিত সয়াবিন তেল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ে। পাশাপাশি ১৩ হাজার টন পাম অয়েলবাহী ‘এমটি সুমাত্রা পাম’ জাহাজটিও প্রায় কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। এ তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে তেল নিয়ে একটি জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে।

যা দেশের শীর্ষস্থানীয় চারটি কোম্পানী সিটি গ্রুপ, সেনা কল্যাণ, এডিবল অয়েল, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ও বসুন্ধরা গ্রুপ আমদানি করা তেলের খালাস প্রক্রিয়া শুরু করেছে। চট্টগ্রাম কাষ্টমস সূত্রে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ আমদানিকারকরা ইন্দোনেশিয়ান সরকারের নিষেধাজ্ঞার আগেই প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টন পামঅয়েল আমদানি করেছে। বাংলাদেশকে বছরে প্রায় ১৩ লাখ টন পাম অয়েল আমদানি করতে হয়।

এর মধ্যে ৯০ শতাংশই আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে, আর বাকী ১০ শতাংশ আমদানি হয় মালয়েশিয়া থেকে। দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের বেশি ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। দেশীয় ভাবে মাত্র যৎসামান্য ভোজ্যতেল উৎপাদন হলেও বাকীটার পুরো অংশই আমদানি নির্ভর। মূলত যে কোন রাষ্ট্র জনস্বার্থে যে কোন পণ্য আমদানি কিংবা রফতানি করে থাকে।

আবার জনস্বার্থেই আমদানি রফতানি বন্ধও রাখে। এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক অবস্থাকে আমলে নিয়ে দেশীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনের উপর গুরুত্বারোপ না করলে স্থানীয়ভাবে সংকট নিরসন করার কোন সুযোগ থাকে না। আমাদের দেশটি কৃষি নির্ভর। আর ভোজ্যতেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবিন, সূর্যমুখীর ব্যাপক চাষাবাদ বৃদ্ধি করা গেলে পর্যায়ক্রমে এ সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

কিন্তু বাস্তবে দেশে ভোজ্যতেলের কাঁচামাল উৎপাদনের অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকার পরও উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব ও বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় দেশে ভোজ্য তেলের কাঁচামাল সয়াবিন, সূর্যমুখী ও ভুট্টার চাষাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অথচ হাওড় ও চরাঞ্চলে এখন ব্যাপকভাবে সূর্যমুখী ও সয়াবিনের চাষাবাদ করা সম্ভব। এটাই পুঁজিবাদী একটি রাষ্ট্র কাঠামোর চরিত্র।

যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে শ্রেণী স্বার্থে গুটিকয়েক শিল্পগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য আমদানি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় না। উল্টো দিন দিন চাহিদার বিপরীতে আমদানি নির্ভরতা বেড়েই চলছে।

ফলে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ নদীমাতৃক বাংলাদেশের কমবেশি সকল নদীতে বিশাল বিশাল চরের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে সয়াবিন ও সূর্যমুখী ফুলের ব্যাপক চাষাবাদ করা সম্ভব। শুধু উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাবে সম্ভাবনার শত সুযোগ আতুর ঘরেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

তবে স্বস্তির খবর ইতিমধ্যেই কুমিল্লার মুরাদ নগরে ২২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টিতে পরীক্ষামূলকভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার ও বীজ প্রণোদনার মাধ্যমে চাষ শুরু করেছে সূর্যমুখী ফুলের। প্রথমবারেই ফলন ভাল হওয়ায় চাষীরা দারুণ খুশি। শুধু কুমিল্লায় নয়, হাওড় খ্যাত সুনামগঞ্জ এলাকায় এখন ব্যাপকভাবে সূর্যমুখী ফুলের চাষাবাদ শুরু হয়েছে।

সূর্যমুখী ফুল থেকে তেল, খৈল ও জ্বালানি পাওয়া যায়। প্রতি বিঘা জমিতে ৭ থেকে ১০ মণ বীজ উৎপাদন হয়। যা থেকে প্রায় ১৪০ থেকে ২০০ লিটার পর্যন্ত তেল পাওয়া যায়। এখন এসব প্রতি লিটার তেলের বাজার মূল্য প্রায় ২৫০ টাকা। যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এ তেল অধিক স্বাস্থ্যসম্মত।

যে কারণে সরকার যদি সূর্যমুখী, সয়াবিন, সরিষার চাষাবাদে প্রণোদনা দিয়ে গোটা দেশেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ব্যাপক পরিকল্পনার ভিত্তিতে তেলবীজের চাষাবাদ বৃদ্ধি করে তাহলে ভোজ্যতেলের উপযোগী ফসল চাষাবাদ করে দেশীয় চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করা সম্ভব।

বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে অমিত সম্ভাবনার দ্বারগুলো শুধু গুটিকতক মানুষের স্বার্থে সেভাবে গ্রহণ করা হয় না। অথচ বিদেশ থেকে প্রতিবছরই মানুষের চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশ ভোজ্যতেল আমদানি করা হচ্ছে। আর দুর্নীতি তো ভালভাবে বাসা বেঁধে বসেছে। শ্রেণী স্বার্থ থাকলে দুর্নীতি থাকবে, আর দুর্নীতি থাকলে জনস্বার্থ, উন্নয়ন সবই পিছিয়ে পড়বে। কারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো অপূর্ণ রেখে ইমারত বানানোকে প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন বলা যাবে না।

প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে সাধারণ মানুষের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা। তা না হলে হয়ত গুটিকতক মানুষ ফুলে ফেপে কলাগাছ হবে, রাস্তা, ঘাট, নগরায়নের জৌলুস বাড়বে সত্য, কিন্তু মানুষের জীবন-জীবিকা হবে অতিকষ্টের। যা ক্ষমতাসীনরা বুঝতে চান না। যাদের মুখে জনকল্যাণের কথা শুনতে শুনতে মানুষ ক্লান্ত হবে, কিন্তু মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না।

মাঝে মধ্যে সংকট নামক অভিশাপ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলবে, পক্ষান্তরে খাগড়াছড়ির রামগড়ে ব্যবসায়ীদের গুদামে  হাজার লিটার সয়াবিন তেলের অবৈধ মজুদ ধরা পড়বে। পরিনামে নাম মাত্র অর্থ দন্ডে ছাড় পাবে, যাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে না। কারণ তাদের আছে খুঁটির জোর! যে জোরের বলে নামমাত্র জরিমানায় বড় বড় অপরাধ করার পরও বেশি শাস্তি ভোগ করতে হয় না।

বাস্তবতা হচ্ছে, ঘুঁনে ধরা পচা সমাজব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন করা না গেলে গুটিকতক শিল্প গোষ্ঠী ও হাতে গোনা স্বল্প সংখ্যক মানুষের বিলাস বৈভব জীবন-যাপন যেমন বাড়বে, তেমনি সাধারণ মানুষের পকেট কেটে শূন্য করে নিজেরা টাকার পাহাড় গড়ে তুলবে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে যখন দেশের ৪ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়, তখন দেশে কোটিপতির সংখ্যা সমানেই বৃদ্ধি পায়। যে কারণে সাধারণ মানুষকে বাঁচতে হলে সমাজব্যবস্থা  বদলের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যা ব্যতিত অন্য কোন বিকল্প নেই।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS