ভিডিও

নীরব দৃষ্টিঘাতী চোখের ব্যাধি গ্লুকোমা

অধ্যাপক ডাঃ এন সি বাড়ই

প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২৪, ০৫:২১ বিকাল
আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২৪, ১১:৪৮ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে দৃষ্টিময় চোখ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্ব এতই বেশি যে, স্বয়ং ঈশ্বরই অন্য ইন্দ্রিয় গুলোর সেবায় একটা বা দুটা লাগালেও বারোটি মস্তিষ্ক স্নায়ুর পাঁচটিকেই চোখের সেবায় নিয়েজিত করেছেন।এই চোখে না দেখতে পারার বেদনা দৃষ্টিহীন মানুষ ছাড়া সঠিক উপলব্ধি করতে পারেন না।

চক্ষু বিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবীর মানুষের কত মানুষ এবং কোন কারণে অন্ধ তা নির্ণয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন করে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং প্রতিকারের দিকে নজর দিচ্ছেন। আমরা ভাবি ছানি অন্ধত্বের সবচেয়ে বড় কারণ। কিন্তু ছানির তো এখন সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা আছে, অপারেশন করলেই আবার দেখতে পাবেন। কিন্তু গ্লুকোমা বড় নির্দয়, জ্যোতি যেটুকু কেড়ে নেবে তার কিঞ্চিতও ফেরৎ দেবেনা। অথচ এই গ্লুকোমা কিন্তু প্রতিরোধ করা যায়। শুধুমাত্র সচেতনতা প্রয়োজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মর্মোপলব্ধি করেছেন বলে অন্যান্য রোগের কেবল ‘দিবস’ আছে আর গ্লুকোমার জন্য পুরো একটা সপ্তাহ  “গ্লুকোমা সচেতনতা সপ্তাহ” ঘোষণা করেছেন। সেটা হলো প্রতি বছর ১০ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ। এই সপ্তাহটা ৪০ এর বেশি বয়সী মানুষের মনের মধ্যে গেথে দেয়া দরকার যাতে তারা প্রতি জেলায় যেখানে গ্লুকোমা স্ক্রিনিং হচ্ছে সেখানে গিয়ে বিনা মূল্যে দৃষ্টিশক্তি, চোখের প্রেসার ও চোখের নার্ভের মাথাটার সাথে সাদা জায়গাটার রেসিও (কাপ) মেপে নিয়ে আসেন।

এই রেসিও ১০ : ৩ স্বাভাবিক। যেমন বগুড়ায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১৪ মার্চ সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চল্লিশোর্ধ্ব সবার সেবা দিব। কারুর গ্লুকেমা ধরা পড়লে পরবর্তী একদিন ধার্য করা হবে। নিশ্চিত হওয়ার পরীক্ষাগুলো ৫০% ছাড় দিয়ে করার পরে চিকিৎসা দেয়ার জন্য।

সারা পৃথিবীতে ৮ কোটি মানুষ এই মুহূর্তে গ্লুকোমায় ভুগছেন। আমাদের দেশেও একটা সার্ভে হয়েছে।এখনো ফলাফল প্রকাশের অপেক্ষায়। তবে আমরা যা দেখতে পাই তাতে ৪০ উর্ধ্ব মানুষের মধ্যে প্রায় ৩%। এই মুহূর্তে দেশে গ্লুকোমার রুগি প্রায় ৩০ লাখ। তাহ’লে গ্লুকোমাা একটা সার সংক্ষেপ আলোকপাত করা যেতে পারে।

চোখের বাইরের তিনটি দেয়াল ছাড়া কোন রক্ত নালী নেই। অথচ কর্ণিয়া, লেন্স, ভিট্রাসের মত গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। তাদের পুষ্টির জন্য রক্তের নির্যাস থেকে একটা জলীয় পদার্থ পুষ্টির সব উপাদান নিয়ে তৈরি হয়, তার নাম ‘একোয়াস হিউমার’। যে পরিমাণ তৈরি হচ্ছে তা কাজ শেষে বেরিয়ে যাবার রাস্তাও রয়েছে।

এই পানিটা অনবরত সারকুলেট করছে একটা গ্লোবের মধ্যে যার পিছনে রয়েছে মস্তিষ্ক থেকে আসা অপটিক নার্ভ যা কিনা ১২ লক্ষ সুতার মত নার্ভ ফাইবারের একটা বান্ডিল। পানির একটা প্রেসার চোখে থাকা তাই বাঞ্ছনীয়। সেটা কত? ১০ থেকে ২২ মি মি অফ মার্কারি। এই ২০/২২ প্রেসার উৎরে নার্ভ থেকে আসা রক্তনালিগুলো কিন্তু‘ পুষ্টি দিয়ে চলেছে।

এখন ধরুন প্রেসারের কারণ যে নির্যাস বা ‘একোয়াস’ তা বেরুতে বাধা পাচ্ছে, তাহলে প্রেসার বাড়বে। প্রেসার বাড়লে চারিদিকের শক্ত দেয়াল বা সামনের কর্নিয়া সামলে নিলেও বেচারী দুর্বল নার্ভটার সুতোগুলো চাপের ফলে শুকোতে থাকলো। আমাদের দৃষ্টিকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি একটা সম্মুখ দৃষ্টি (সামনে দেখা) আর একটা পার্শ্বে দৃষ্টি (সামনে তাকালেও পাশে দেখতে পারা)।

সামনে দেখার ম্যাকুলার নার্ভ ফাইবারগুলোর রক্ত সঞ্চালন ভালো বেশি বলে সামনের দৃষ্টিটা ধ্বংসযজ্ঞ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভালো থাকে, গ্লুকোমার রোগীরা ভাবেন দেখতে পাচ্ছিইতো। কিন্তু সেটা টানেল ভিশান। কিছুদিন পরে যখন সেটাও শেষ হয়ে যায় তখন তিনি পুরো অন্ধ এবং সবরকম চিকিৎসার বাইরে।এই চিকিৎসার বাইরে চলে যাওয়ার সংখ্যা দেশে ১০ লাখের উপরে।

একটু একটু করে অন্ধ হওয়াকে বলা হয় ‘ওপেন এক্সেগল গ্লুকোমা, বা চোরা গ্লুকোমা। আর একটা আছে যেখানে পানি প্রবাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। রোগী হঠাৎ দেখতে পায়না। প্রথমে কোন গোল আলোর দিকে তাকালে ঝাড় বাতির মত রংধনু দেখতে পায়।

তারপরে অন্ধ, ব্যথা এত অস্বাভাবিক যে ব্যথায় বমি করা, বিছানায় গড়াগড়ি করে তবে ডাক্তারের কাছে আসা।এটা ডাকাত গ্লুকোমা। (ক্লোজ এঙ্গেল গ্লুকোমা।) তবে এতে রোগি দ্রুত চিকিৎসার সুযোগ পায়, কারণ তাকে ডাক্তারের কাছে আসতেই হয়।

জন্মগতভাবে মাতৃগর্ভে শিশুর চোখের গঠন যথেষ্ট না হলে পানি যাবার রাস্তা খোলেনা, প্রেসার বাড়ে,জন্মেই অন্ধ, চোখ দেখতে বড়বড়, কালো মনি ঘোলা, কারণ এগুলো তখনো নরম। ১৫ থেকে ৩৫ বছরেও মুক্ত কোণ গ্লুকোমা হয়, সেটা ‘জুভেনাইল গ্লুকোমা’।

লেন্সের পুরুত্ব যদি এত বড় হয় যে পানি যাবার রাস্তা ছোট বা বন্ধ করে দেয়, তাতেও গ্লুকোমা হয়। ছানি সময়মত না সরালে, আঘাত লেগে, বারবার চোখের ভিতরে ইনফ্লামেশান হলে চোখের প্রেসার বাড়ে। অনিয়ন্ত্রিত দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস থাকলে পানি যাওয়ার পথ নতুন রক্তনালিতে আটকে দেয় তখন যে গ্লুকোমা হয় তা সারানো বেশ কঠিন।

গ্লুকোমা যে দৃষ্টি নেয় তা ফেরৎ আনা যায়না যা থাকে সেটুকু ধরে রাখাটাই চিকিৎসা। তাই যদি হয়, তবে গ্লুকোমাকে চোখের জ্যোতি নিতে দেব কেন। এটাই গ্লুকোমার সচেতনতা বাড়িয়ে চল্লিশের উপরের সব মানুষ যেন বছরে একবার চোখের ডাক্তার দেখায় তার সপ্তাহ পালন।

প্রথমেই সচেতন হ’লে গ্লুকোমার ভালো ভালো ওষুধ আছে যা প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কি না যেমন রুটিন করে দেখতে হয়, গ্লুকোমা ধরা পড়লেও তাই। কোন এক পর্যায়ে যদি ওষুধে প্রেসার কন্ট্রোল হচ্ছেনা ডাক্তার মনে করেন তাহলে এর অপারেশান রয়েছে। অপারেশানের ফলাফল ভালো। প্রাথমিক পর্যায়ে লেজার অপারেশান, না হলে পরে সার্জিকাল। তবে প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে।

এখন কত প্রেসার কার জন্য স্বাভাবিক সেটা ডাক্তার বুঝতে পারবেন। যাদের চোখের নার্ভ ২০/২২ ও সহ্য করতে না পেরে ক্ষয়ে যেতে থাকে তাকে বলা হয় ‘নরমোটেনসিব গ্লুকোমা’। তাদের প্রেসার ৮/১০ এ নামিয়ে রাখাটিই নিয়ম।অনেকের চোখের প্রেসার ২৫/৩০ অথচ নার্ভ এত শক্ত যে ক্ষয়ে যায় না, গ্লুকোমা নেই।

তাদের ভবিষ্যতে বয়স বাড়ার ফলে নার্ভ যখন দুর্বল হতে থাকবে তখন গ্লুকোমা হতে পারে। সুতরাং প্রেসার কমিয়ে রাখতে হবে। গ্লুকোমার ক্ষতিটা ডাক্তাররা চোখের প্রেসার, কর্ণিয়ার পুরুত্ব, নার্ভের মাথাটার সাথে মাঝের সাদার রেসিও, ফিল্ড এনালাইসস এবং ও সি টি করে বুঝতে পারেন। রোগী কিন্তু এসে বলেনা যে তার গ্লুকোমা হয়েছে।

গ্লুকোমার সঠিক কারণ নির্ণয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। যতটুকু জানা যায় তাতে একটা বংশগত ধারা পরিলক্ষিত হয়, অর্থাৎ জেনেটিকাল। জন্ম ত্রুটির একটা কারণে শিশু গ্লুকোমা হয়। আঘাত, হাই মাওপিয়া (যারা মাইনাস লেন্স পরেন), ডায়াবেটিস, দীর্ঘদিন ধরে কোন কারণে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা, ছানি ইত্যাদিতে সেকেন্ডারি গ্লুকোমা হয়।

যেহেতু গ্লুকোমার হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি ফেরৎ পাওয়া যায় না, তাহলে হারাবার আগেই সচেতন হতে হবে। ঘনঘন চোখের পাওয়ার পাল্টে যাচ্ছে, সামনে তাকালেও পার্শ্বে জ্যোতির কোথায়ও কালো ছায়া মনে হচ্ছে, বংশে গ্লুকোমা থাকলে, ডায়াবেটিস থাকলে, আঘাত লাগলে, আলোর চারিদিকে ঝাড়বাতির মত রংধনু দেখতে পেলে অবশ্যই চোখ দেখাতে হবে।

এবারে গ্লুকোমা সপ্তাহের শ্লোগান হলো “একসঙ্গে হাত ধরি,  গ্লুকোমামুক্ত বিশ্ব গড়ি।”আমরা স্ক্রিনিং করছি, আপনারা শুধু সেবাটা নিয়ে আমাদের এ লক্ষে পৌছুতে সাহায্য করুন।


লেখক: চক্ষুচিকিৎসক, গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
নেত্রালয় আই কেয়ার সেন্টার
বগুড়া



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS