ভিডিও

প্রচন্ড দাবদাহ আমাদেরই সৃষ্টি

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: মে ০৪, ২০২৪, ০৬:৩৩ বিকাল
আপডেট: মে ০৪, ২০২৪, ০৬:৩৩ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

মানব শরীরের তাপমাত্রা ও পানির সাম্যতা রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কোন কারণে যদি ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তখন পূরো ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে। এ জন্য থার্মোরেগুলেশন এবং অসমোরেগুলেশন মানব শরীর সহ অন্যান্য প্রাণীর জন্য অত্যাবশ্যক কার্যক্রম। ছোট বেলা হতে আমরা শুনে আসছি অতিরিক্ত যেকোন জিনিসই খারাপ।

প্রয়োজনের চেয়ে বেশী খাবারও শরীরের জন্য বিষ। ভারসাম্যতা বা হোমিওষ্ট্যাটিস সামাজিক জীবন , ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবেশ সকল ক্ষেত্রেই অতীব জরুরি। মানব শরীরে পানি ও তাপের -ভারসাম্যতা পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবেশের অন্যান্য উপাদান ও জনস্বাস্থ্যে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে।

শরীর বৃত্তীয় সকল কার্যক্রম সঠিকভাবে চলতে শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সে. থাকা জরুরি। এই তাপমাত্রায় শরীরের সকল এনজাইম হরমোন সঠিকভাবে কাজ করে। যদি এর চেয়ে বাড়তে থাকে তবে নেগেটিভ ফিডব্যাকের মাধ্যমে শরীর তা ঠিক রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু অতিরিক্ত বেড়ে গেলে শরীরের হোমিওষ্টেসিস প্রক্রিয়া আর কাজ করেনা। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার হিসাব অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা বিরাজ করে তা থেকে ৫০ ডিগ্রি সে. বেড়ে গেলে এবং তা পরপর ৫দিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলা হয়।

আমাদের দেশে এই হিটওয়েভ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সে. থেকে (আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্য মতে )। বর্তমানে কিছু কিছু স্থানে তা প্রায় ৪৩ ডিগ্রি সে.। তাহলে বুঝতে আর বেশী কষ্ট হওয়ার কথা নয় আমরা কি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। বিগত ২৮ বছরের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রচন্ড দাবদাহে জ্বলছে সারাদেশ। এই পরিস্থিতি কি মানব সৃষ্ট না কি প্রাকৃতিক প্রতিশোধ।

আমরা যে ভাবেই বলি না কেন মূল কারিগর হল মানুষ। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সকল প্যারামিটার আমরা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েই চলেছি। খুব গভীরভাবে না ভাবলেও হবে। সাধারণভাবেই যদি চিন্তা করেন দেশে জীবাশ্ম জ¦ালানীর ব্যবহার প্রতিক্ষণ বাড়ছে না কমছে। প্রতিদিন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক গাড়ীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর পরিমাণ।

সারা বিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানীর পোড়ানোর কাজ  প্রতিদিন বেড়েই চলছে। এই সাথে আমাদের দেশের তো কথাই নেই। ১৯৫০ সাল হতে আজ পর্যন্ত তা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন রেফ্রিজেরেটর এবং এসি ব্যবহারের পরিমাণ এক্সপোনেনমিয়ালভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বনায়ন ধ্বংসের পরিমাণ, অকল্পনীয়ভাবে এবং অপরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কংক্রিটের বাড়ি ঘর।

এবার আসছি এতগুলো বৃদ্ধির কবলে পড়ে যে মূল্যবান জিনিসটি হারিয়ে ফেলেছি তা হলো গ্রীন হাউজ গ্যাসগুলোকে গ্রহণ করে বাতাসকে বিশুদ্ধ ও পরিশুদ্ধ করে সেই সবুজ গাছপালাকে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্ম পরিকল্পনার তথ্য অনুসারে কোন আইডিয়াল শহর হলো যে শহরে ২৫% বনায়ন বা গাছপালা আছে।

২০২০ সালের এক জরিপে দেখা যায় ঢাকা শহরে বনায়নের পরিমাণ ৮%। বর্তমানে তা আরও কমে যাচ্ছে। বিপরিত দিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইট পাথরের ইমারত আর ইট বানানোর ভাটা। ঢাকা শহরের প্রতিটি সিগনালে প্রতিদিন পড়ছে বিশাল বিশাল জ্যাম যা অকল্পনীয়ভাবে গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা এমন এক ট্র্যাপ তৈরি করছে যার মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে কিছু কিছু ওয়েভ লেন্থ বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করে আর সেই ট্র্যাপ হতে বের হতে পারছে না।

যার ফলে প্রতিনিয়তই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই ভাবে কিছু গ্যাস ওজোন (O3) স্তরের সাথে বিক্রিয়া করে তা ছিদ্র করে ফেলছে এবং এই ছিদ্র দিয়ে আরও ভয়ঙ্কর অতিবেগুনী রশ্মি প্রবেশ করে ক্যান্সারের মত ভয়াবহ রোগ তৈরি করছে। একই ভাবে তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যতগুলো গ্রীন হাউজ গ্যাস আছে তাদের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই গ্যাসটি সবুজ গাছ দ্বারা শোষিত হয়ে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার কাঁচামাল হিসাবে কাজ করে। এই গ্যাসটি ডিফরেষ্টেশন বা বনায়ন ধ্বংসের কারণে একদিকে যেমন শোষিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না, অন্য দিকে তেমন ইটের ভাটা ও জীবাশ্ম জ্বালানীর যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে দিন দিন কার্বন ডাই অক্সাইড মারাত্মকভাবে বেড়েই চলছে। এই নাজুক পরিস্থিতির অবসান কিভাবে সম্ভব তাই বলছি।

প্রথমত : দেশের সকল বড় বড় শহরের বনায়ন এর শতকরা ভাগ নির্ণয় করতে হবে। সকল বিভাগীয় ও জেলা শহরে দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে আলাপ আলোচনা করে সামাজিক বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে। অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বনায়নের প্রয়োজনিয়তা বুঝাতে হবে। এটা ধরিত্রীর কুলিং সিষ্টেম হিসাবে কাজ করে।

মানবদেহের ফুসফুস যেমন পরিষ্কার বাতাস গ্রহণ করে রক্ত পরিষ্কার করে দেহের সকল কার্যক্রম ঠিক রাখে তেমনভাবে কমপক্ষে ২৫% বনায়ন কোন এলাকার সকল দুষিত বাতাস বা কার্বন ডাই অক্সাইড যুক্ত বাতাস গ্রহণ করে অক্সিজেন যুক্ত বাতাস সরবরাহ করে। যে হারে জীবাশ্ম জালানী পুড়ে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরি হচ্ছে অপর দিকে সবুজ বনায়ন ধ্বংস হচ্ছে এরই মারাত্মক প্রভাব হিসাবেই এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রা।

দ্বিতীয়ত : শহরাঞ্চলে যে সকল পার্ক বা বিনোদনের জায়গা আছে যেসব স্থানে সবুজ গাছপালা সংরক্ষণ ও বর্ধন নিশ্চিত করতে হবে। যেসব রাস্তার পাশে কোন গাছ নেই অথবা গাছের উপর ধুলাবালির মোটা আস্তরণ পড়ে মৃত প্রায় সেই সকল রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং সংস্কার করে পরিচ্ছন্ন গাছ সংরক্ষণ করা জরুরী। বিশেষজ্ঞেদের দ্বারা গঠিত টিম দিয়ে গাছের শ্রেণী বিভাগ করে স্থান ভেদে তা রোপণ ও পরিচচা নিশ্চিত করতে হবে।

তৃতীয়ত : বনায়ন ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত আইনের প্রয়োগ হতে হবে সিদ্ধ হস্তে। কারণে অকারণে কোনো ভাবেই গাছ কাটা যাবে না। একান্ত প্রয়োজনে একটা গাছ কাটলে কমপক্ষে ২টি গাছ লাগাতে হবে। কারণ সবুজ বনায়নের পরিমাণ কোনভাবেই ২৫% এর কম হওয়া যাবে না।

চতুর্থত : যে সকল জলাধারের পাড়ে ব্যক্তি মালিকানায় গাছপালা আছে সেগুলো সংরক্ষণে জনসচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। এবারের বিশ^ স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান হলো “আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে যেমন ২টি বিষয় আমাদের সামনে প্রতীয়মান হয় তাহলো ১. স্বাস্থ্যে আমার নিজের দায়িত্ব ২. স্বাস্থ্য আমার অধিকার।

স্বাস্থ্যকে বিশ্বের কমপক্ষে ১৪০টি দেশ মানবাধিকার হিসাবেই বিবেচনা করে তাদের নিজ নিজ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই অধিকার সংরক্ষণের পথে অনেকগুলি বাঁধা আছে। মানবাধিকার যেমন ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। যেমন- ভাবে যুদ্ধ বিগ্রহ হানাহানি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে একইভাবে পরিবেশের উপর নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ করে প্রকৃতিকে করে তুলছি বিরূপ।

তাই শান্তি স্থাপন করে প্রকৃতির সহজাত অবস্থান ফিরিয়ে এনে আমার অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি নিজে মনোনিবেশ করা। নিজে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে নিয়মিত ব্যয়াম ও শরীর চর্চার মাধ্যমে নিজের দায়িত্ব পালন করা। আর এভাবেই গড়ে উঠুক সুস্বাস্থ্যের শান্তিময় পৃথিবী।


লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কীটতত্ত্ব বিভাগ
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
মহাখালী, ঢাকা।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS