ভিডিও

বিদেশে কর্মি যাওয়ার হিড়িক কিন্তু রেমিট্যান্স বাড়ে না

আব্দুল হাই রঞ্জু

প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৪, ০৭:৩৫ বিকাল
আপডেট: মে ১৮, ২০২৪, ০৭:৩৫ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

জনশক্তি রফতানি এবং রেমিট্যান্স একে অপরের পরিপূরক। অর্থাৎ জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধি পেলে রেমিট্যান্স বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পোশাক খাতের পরের স্থানটি ধরে রেখেছে রেমিট্যান্স খাত।

বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কবলে পড়ে যখন উন্নত দেশসহ কম-বেশি সকল দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে, সে সময় আমাদের দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি ভাল থাকায় দেশের অর্থনীতি অনেকটাই ভাল ছিল।

এখন করোনার দাপট গোটা বিশ্বে কমে এসেছে, ধীরে ধীরে অর্থনীতিও চাঙ্গা হলেও আমাদের দেশের টাকার মান দুর্বল হচ্ছে। এর মূল কারণ অতি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় প্রতিটি পণ্যের আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে বৈদেশিক রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ছে। আবার ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমাদের টাকার মানও কমে আসছে।

এ লক্ষণ কোন অবস্থাতেই ভাল না। সার্কভুক্ত জোটের শরিক শ্রীলংকায় হাঠাৎ আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভ অনেকটা শূন্যের কোঠায় চলে এসেছিল। দেশটির অর্থনীতিও তখন চরম ভাবে বিপর্যস্ত ছিল। তখন ব্যাপক গণবিক্ষোভ ও গণ আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে ছিল। আন্দোলনের মুখে দেশটির ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেও রেহাই পাননি, সেনা ঘাঁটিতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।

এখানে স্পষ্ট জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। এখনও দেশটির রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভাল না। তবে তারা অর্থনীতিকে পুনর্জীবিত করে কিছুটা হলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমাদের যেন এমন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়, সে জন্য রিজার্ভে টান পড়ে এমন পরিস্থিতি থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। অর্থাৎ আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। তাহলেই শুধু পরিস্থিতি সামাল দেয়া সহজ হবে।

যেহেতু দেশের পোশাক খাতের রফতানি আয় অনেকটাই ইতিবাচক, সেখানে আশা করতেই পারি চট করে আমাদের অর্থনীতি বিপর্যস্তের মুখে পড়বে না। তবে আশা নিয়ে থাকলেই হবে না। বাস্তব সম্মত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেশীয় ভাবে ধান, চালের পাশাপাশি গম উৎপাদনে বিশেষ নজর দিতে হবে।

কারণ প্রতিবছরই প্রায় ৫০/৬০ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি করতে হয়। যা কোন ভাবেই আমাদের জন্য শুভ নয়। কারণ ভাতের পরে আটা-ময়দার অবস্থান। আর এখন ভাতের চেয়ে আটা-ময়দার চাহিদা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গমের উৎপাদন বাড়াতে হবে। তাহলে আমদানি কমে আসবে, রিজার্ভেও কম চাপ পড়বে।

আর আমাদের বড় শক্তি মানবসম্পদ। যে মানব সম্পদকেও আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। এটা আমাদের বড় দুর্বলতা। কারণ যে দেশের মানুষ অলসভাবে বসে থাকার বদলে শুধু কাজ চায়, সে কাজ দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই হোক না কেনো। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, আমাদের সরকার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না।

অর্থাৎ দেশে কলকারখানা গড়ে না উঠলে এবং সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, এটাই চিরন্তন সত্য। ফলে বাধ্য হয়েই দেশের তরুণ ও যুব সমাজ কাজের চাহিদা পূরণ করতে বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। বাস্তবে যে হারে বিদেশে কর্মী যেতে চায়, সে হারে যেতেও পারে না। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে বেশি কর্মী যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

অতিসম্প্রতি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর প্রবাসী আয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ‘অভিবাসন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রবাসী আয়ে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মধ্যে ব্যাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। শীর্ষ দেশের তালিকায় রয়েছে ভারত, মেক্সিকো, চীন, ফিলিপাইন, মিশর ও পাকিস্তান। আর দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের পরে স্থানটি দখলে রেখেছে বাংলাদেশ।

উক্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি এসেছে মাত্র ২ দশমিক দুই শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক বলেছে এ বছরের শেষ নাগাদ প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা হলেও বাড়বে। মূলত রেমিট্যান্স বৈধ পথে আনতে সরকারি প্রণোদনার কারণে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কালেও ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি বেশ ভাল ছিল।

আশার কথা, চলতি বছরেরর প্রথম ২ মাসের তুলনায় মার্চে বেশি পরিমাণ কর্মী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন। জনশক্তি রফতানিকারক ও অর্থনীতির গবেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশের প্রধান জনশক্তি রফতানির বাজার। মূলত করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে এসব দেশের অর্থনীতি অনেকটা চাঙ্গা হওয়ায় কাজের লোকের চাহিদা অনেক বেড়েছে। ফলে জনশক্তি রফতানিও বেড়েছে।

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) গত বছর জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ৪৮ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে কাজ করছেন। ২০২৩ সালে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার, আর দেশ থেকে বিদেশী কর্মরতরা নিয়ে গেছেন ১০ বিলিয়ন ডলার।

এর মূল কারণ হলো বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী কর্মীদের অধিকাংশই আধা দক্ষ, স্বল্প দক্ষ কিংবা অদক্ষ। আর বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের প্রায় শতভাগই দক্ষ কর্মী ও উচ্চ বেতনভোগী। বিএমটিএর তথ্য অনুসারে শুধু ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে ১২ লাখ ৪৬ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে অর্ধেক কর্মীই ছিলেন অদক্ষ, ২ লাখ ৬১ হাজার আধা দক্ষ, আর ৩ লাখ ৮ হাজার দক্ষ।

অর্থাৎ দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। যেন হাতে কলমে দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে পারে। তাহলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়ে যাবে। শংকার বিষয় হচ্ছে, এক সময় মালয়েশিয়া আমাদের শ্রম বাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। যা গত দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

ফলে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার পর স্বল্প পরিসরে কর্মী গেলেও যা আশানুরুপ নয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক বলেন, মালয়েশিয়ায় অধিক পরিমাণ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।

মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর মতো আমাদের খনিজ সম্পদ তেল, সোনা না থাকলেও আছে মানবসম্পদ। প্রবাদ আছে, ‘পরিশ্রমে ধন আনে, পুণ্যে আনে সুখ’। আমাদের সেই পরিশ্রমের বড় হাতিয়ার হলো ‘মানবসম্পদ’। অথচ সেই মানবসম্পদকে আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না।

কারণ যারা বৈধ অবৈধ পথে টাকা জমায়, তারা সে টাকা দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করে। কেউ কেউ সেকেন্ড হোম বানায়, বেগম পাড়ায় বাড়ি কেনে। ফলে বিনিয়োগের অভাবে দেশে কলকারখানা গড়ে ওঠে না। উল্টো নিত্যপণ্য দেশে উৎপাদন না হওয়ায় প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে।

যে কারণে বিদেশে কষ্টের জীবন পাড়ি দিয়ে অমূল্য সম্পদ রেমিট্যান্স এর পাহাড় দেশে গড়ে উঠলেও সেই রেমিট্যান্সের উপর চাপ পড়ায় আশংকাজনক হারে রেমিট্যান্স কমে আসছে। যদিও একটি দেশের ৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকলেই সমস্যা থাকে না। কিন্তু আমাদের রিজার্ভ সেখানে কয়েক গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার পর এখন শোনা যাচ্ছে রিজার্ভে টান পড়েছে।

মোদ্দা কথা, নিত্যপণ্যের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় ভাবে উৎপাদন বাড়াতে হবে। তাহলেই শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভকে ধরে রাখা সম্ভব হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে আসলে কিম্বা শূন্য হলে কি পরিণতি হয় তা শ্রীলংকার বিপর্যস্ত অর্থনীতি থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।

যে কারণে খাদ্যের মধ্যে চাল, গম, তেল, চিনি সহ অন্যান্য নিত্যপণ্য দেশীয় ভাবে উৎপাদন করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করতে হবে। আর দেশীয় ভাবে উৎপাদন করার মত উর্বর জমি, সার, বীজ, শ্রমিক থাকার পরও কেন আমরা নির্ভরশীল হতে পারছি না? এর সোজা সাপটা জবাব হলো, একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোয় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে বরং গুটিকতক শিল্প গোষ্ঠীর স্বার্থে আমদানি নির্ভরতাকে জিয়ে রাখা হয়।

ফলে সাধারণ ভোক্তাদের চড়া দামে আমদানিকৃত পণ্য কিনে খেতে হয়। অন্যদিকে কষ্টার্জিত  অর্থ রিজার্ভও কমে আসে। অথচ সরকারিভাবে প্রণোদনা, সহায়তা, ভর্তুকী কৃষিতে আরো বৃদ্ধি করতে পারলে দেশীয় ভাবে নিত্যপণ্যের চাষাবাদ করে নিজস্ব চাহিদার পুরোটাই পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা মুখে কৃষকের স্বার্থের কথা বলে সত্য, কিন্তু চাষীরা গম, ভুট্টা, সয়াবিন, সূর্যমুখী ফুলের ব্যাপক চাষাবাদ করেও উপযুক্ত মূল্যের অভাবে চাষাবাদ কমিয়ে দেয়। কৃষি নির্ভর আমাদের দেশ।

আমাদের দেশের মাটি উর্বর। এমনকি এখন বিশাল বিশাল চরাঞ্চলের দোঁআশ মাটিতে গম, ভুট্টা, সরিষা, সয়াবিন, সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে দেশীয় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। শুধুমাত্র সরকারের উদাসিনতা, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দিন দিন নিত্যপণ্যের উৎপাদন কমে আসছে, পরিণামে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে।

আর আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধির কারণে কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের অর্থ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দেশীয় ভাবে নিত্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে, যা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS