ভিডিও

মশক দমনে সমন্বিতভাবে সার্বিক ব্যবস্থাপনা

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: জুন ০৩, ২০২৪, ০৫:৫১ বিকাল
আপডেট: জুন ০৩, ২০২৪, ০৫:৫১ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

একটি গল্প দিয়ে শুরু করি, এক দেশে ছিল এক রাজা। তিনি কাউকেই বিশ^াস করতেন না। তাই এক বানরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজের নিরাপত্তায় নিয়োজিত করলেন। বানরটিও সুবোধ নিরাপত্তা কর্মীর মতই মহারাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবেই থাকে।

একদিন বানরটি দেখলো মহারাজা বিশ্রাম নিচ্ছেন আর একটি মশা তাঁর গালের উপর বসেছে। বানরটি অনেক চেষ্টা করেও মশাকে তাড়াতে অক্ষম হল। শেষ পর্যন্ত বানরটি রেগে উঠে গিয়ে একটি অত্যন্ত ধারালো তলোয়ার নিয়ে আসলো।

তলোয়ার এনে দেখে মশাটি গাল থেকে উড়ে গিয়ে মহারাজার গলার উপর পড়েছে। সাথে সাথে বানরটি ধারালো তলোয়ার দিয়ে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তলোয়ার চালিয়ে দিল। মশাটি স্বাচ্ছন্দ্যে উড়ে গেল আর বাকীটা ইতিহাস রচিত হল।

আমাদের বর্তমান অবস্থা কি এই জ্ঞানী মহারাজার মতো হতে চলেছে কিনা। মশক দমনের জন্য শুধুই রাসায়নিক পদার্থ লার্ভি সাইড বা এডাল্টি সাইডের উপর নির্ভরশীলতা অর্থাৎ একটি মাত্র ব্যবস্থাপনা কি আত্মঘাতী পদক্ষেপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা। যেখানে বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহৃত হবে সেখানে অবশ্যই পরিবেশ ও পরিবেশের প্রাকৃতিক উপাদান, বায়োটিক ও এবায়োটিক উভয়ের উপস্থিতি ও তাদের সংরক্ষণ সহ জীব বৈচিত্র্যের সুসংহতের কথা অতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে।

দায়িত্ব ঠিক তাদের হাতেই দিতে হবে যারা সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। কোন নির্দিষ্ট স্থানের পরিবেশ বসবাসকারী জীব-জন্তুর জন্য অনুকুল না হলে পুরো ইকোসিষ্টেম বা বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। সেটা স্থলজ বাস্তুসংস্থান বা জলজবাস্তুসংস্থান। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে শীর্ষে অবস্থান করছে চীন। আর সার্কভুক্ত দেশেগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। জল ও স্থলের পরিবেশে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিষাক্ত উপাদান দ্বারা এমনিতেই অতীব নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

তার উপর মশার জন্য এডাল্টি সাইডের প্রয়োগ স্থলকে এবং লার্ভিসাইড প্রয়োগ জলকে করেছে উপর্যুপুরী বিষাক্ত। এই বিষাক্তের হাত হতে রক্ষা পেতেই হলিষ্টিক এপ্লোচ বা সার্বিক ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। এই সার্বিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে যতগুলো পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে প্রত্যেকটি একে অপরের সাথে কম্পাটেবল হবে। পরস্পরের সাথে সিনারজিস্টিক হবে। অর্থাৎ একে অপরের কর্ম বা ক্রিয়াশীলতা বাড়াবে, কখনই একে অপরের সাথে বিরুপ ক্রিয়াশীলতায় থাকবে না।

আর কীটনাশক বা রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করতে হবে রেশন্যাল বা যুক্তিযুক্ত ভাবে। মানে যেখানে অত্যধিক মশার ঘনত্ব রয়েছে এবং অন্য কোন পদ্ধতি বিবেচনায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখা খুবই প্রয়োজন কীটনাশক প্রয়োগে কোন ভাবেই মশকের প্রাকৃতিক শত্রু, যেমন প্রিডেটরস, প্যারাসাইটস বা প্যাথোজেনের যেন কোন  প্রকার ক্ষতি না হয়।

মশার প্রাকৃতিক শত্রুর ক্ষতিসাধন অর্থ হলো মশকীর শক্তি দ্বিগুণ ভাবে বৃদ্ধি করা। তাই পূর্বের গল্পের কথা মনে পড়ছে। টার্গেট ছিল মশা কিন্তু বানরটি না বুঝে মহারাজাকেই ইতিহাসের পাতায় উঠেছিল। একই ভাবে  কি আমরা  না বুঝে, না জেনে এমন অস্ত্র ব্যবহার করছি এবং এমন ভাবে ব্যবহার করছি যার ফলাফল অতি স্বস্তির বৃষ্টি হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলেই এক অজানা আতংক তাড়া করে ফিরে আমাদের। এক সময় ডেঙ্গুকে নেগলেকটেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ অর্থাৎ সুবিধা বঞ্চিত মানুষের রোগ বলা হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের জীবন যাপনে সকল সুযোগ সুবিধা ভোগকারী ব্যক্তিবর্গও এই ভয়াল রোগের শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।

এর মূলে রয়েছে সমন্বিতভাবে সার্বিক পদক্ষেপের অভাব। গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, উত্তরা, ধানমন্ডি প্রভৃতি সকল এলাকার বাসিন্দারা জীবনের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরির কারখানা বাড়ির গ্যারেজসহ আশে-পাশে রেখে কখনই মশাবাহিত রোগ হতে রক্ষা পেতে পারবেন না। রক্ষা পাওয়ার একটাই মাত্র উপায় আর তা হলো সমন্বিতভাবে সার্বিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ। অর্থাৎ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করে সংঘবদ্ধভাবে এই মহাবিপদের কারণ এডিস মশার দমন নিশ্চিত করতে হবে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সার্বিক বিবেচনায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অনেকগুলো ফ্যাকটর কাজ করে।

এই একই ফ্যাকটর গুলোও কাজ করে ক্ষতিকারক কোন অনুজীব ও পোকা-মাকড়ের ঘনত্ব-হ্রাস বৃদ্ধিতে। একটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয় প্যাথোজিন ও এর বাহক যেকোন পোকা বা কীট হলো জীবন্ত উপাদান যা পরিবেশের সকল উপাদান দিয়ে প্রভাবিত হয়। এখন পরিবেশ যদি অসুস্থ হয় তবে তার জীবন্ত উপাদান পরিবেশ থেকে অবশ্যই বেশী ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবে।

আর পরিবেশের স্বাস্থ্য যদি ভাল থাকে তবে তার অসুস্থতার জন্য দায়ী উপাদান গুলোর দুর্বলতার কারণে অণুজীব ও কীটগুলোও দুর্বল থাকে। ফলে বসবাসকারী মানুষও এইসব ক্ষতিকারক উপাদান হতে সুস্থ থাকে। তাই আমাদের মূল দায়িত্ব হলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পরিবেশের সু-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। আর এই কাজের জন্য চাই সমন্বয়।

সমন্বয় হতে হবে অবশ্যই মিথজীবিতার ভিত্তিতে। কখনই যেন কোন স্থানে প্যারাসাইটিক  বা এন্টাজোনেষ্টিকভাবে সমন্বয় না হয়। এই সিমবায়োটিক সমন্বয়ের সাথে সাথে সার্বিক পদক্ষেপ অর্থাৎ সকলের নিজ নিজ দায়িত্বের ভিত্তিতে কর্ম সম্পাদন করতে হবে। নিয়ে আসতে হবে হারমোনিক সিষ্টেম। একটি শব্দ উৎপাদন যন্ত্র যেমন শুধুই শব্দ দূষণ করতে থাকে। আর অনেকগুলো বাদ্যযন্ত্র একত্রে একটি সুমধুর সুর তৈরি করতে পারে। এই সুর ও তালের মাধ্যমেই তৈরি হয় হৃদয়স্পর্শী গান। ঠিক তেমনি একক পদ্ধতি বা একক চেষ্টা কখনই নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে সফলতা আনতে পারে না।

সফলতা পেতে প্রয়োজন সবার একসাথে একযোগে সমন্বিত সার্বিক পদক্ষেপ। পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী উলবাকিয়া ব্যাকটিরিয়ার উপর চালিত এক গবেষণায় দেখা যায় জনবহুল অঞ্চলে এই বায়োলোজিক্যাল এজেন্ট অত্যন্ত কার্যকর। সেই বিবেচনায় ঢাকা, সিঙ্গাপুর, এবং ব্রাজিলে এই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে মশক দমন যেমন পরিবেশ বান্ধব তেমনি অর্থনৈতিকভাবে দারুন সাশ্রয়ী।

অনুমান করা হচ্ছে প্রতিবছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার সাশ্রয় হবে এই পদ্ধতির যদি সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়। সকল মিডিয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে জনসচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে একই ভাবে স্কুল কলেজ এ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামে মশার বংশবৃদ্ধি ও ইহার প্রজনন স্থল ধ্বংস করার প্রক্রিয়া সমুহ বিভিন্ন বিষয়ের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে।

পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সাথে আমাদের জীবনের ঘনিষ্ঠতা ও প্রয়োজনিয়তা যথাযথ ভাবে পরবতী বংশধরকে জানানো এবং দূষণের বিষক্রিয়া হতে রক্ষা পাওয়ার সকল কলা-কৌশল শিখাতে হবে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির সব শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হলেও ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে সুস্থভাবে অক্সিজেন নেওয়ার পরিমন্ডল। কার্বন-ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড সহ সকল গ্রীন হাউস গ্যাস মানুষেরই সৃষ্টি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এনথ্রোপোজেনিক বা মানুষের কর্মকান্ডই এই গ্রীন হাউস গ্যাসের উৎপত্তির মূল কারণ।

মানুষের সুস্থতার পূর্ব শর্ত যেমন সুস্থ ফুসফুস, একই ভাবে পৃথিবীর সুস্থতার জন্য প্রয়োজন গাছ-পালা শোভিত পরিচ্ছন্ন অক্সিজেন পূর্ণ পরিবেশ। একই ভাবে একাকী মানুষ যেমন সংকীর্ণ ও অসহায় হয়ে পড়ে আর ঐক্যবদ্ধ হয়ে চললে কোন সমস্যাই সমস্যা হয়ে উঠতে পারে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যত বড় বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে সকল সমস্যার সমাধান হয়েছে ঐক্যবদ্ধ ইস্পাতসম শক্তির মাধ্যমে। সার্বিক বিবেচনায় সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে সমন্বিত ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমেই একমাত্র এই ভয়ংকর পরিস্থিতির অবসান সম্ভব।


লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
মহাখালী, ঢাকা।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS