ভিডিও

উন্নয়নের সাথে পরিবেশ সুরক্ষার কাজও চলবে

রাহমান ওয়াহিদ

প্রকাশিত: জুন ০৫, ২০২৪, ০৮:২৬ রাত
আপডেট: জুন ০৫, ২০২৪, ০৮:২৬ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

যে কোন দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বা মানব উন্নয়ন যেটিই হোক-সেসব উন্নয়নের আয়ু ক্ষয় করার অন্যতম প্রধান ব্যাধিই হলো পরিবেশ দূষণ। এ দূষণের মধ্যে রয়েছে বায়ুদূষণ, খাদ্য দূষণ, পানিদূষণ, নদীদূষণ, মাটিদূষণ, শব্দদূষণ ইত্যাদি।

আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে এসব দূষণের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে-এ নিয়ে ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার যত বাড়ছে, পরিবেশউন্নয়ন সূচক ততটাই পিছিয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত ইনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেপ (ইপিআই) প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ১৮০টি দেশকে র‌্যাঙ্কিং করে পর্যবেক্ষণে দেখিয়েছে- বাংলাদেশের অবস্থান সেখানে ১৭৭তম।

উন্নয়নের চলমান অগ্রগতির সাথে পরিবেশের এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে যে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া হয় না, এই সূচকই তার প্রমাণ। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮-ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যতের নাগরিকদের জন্য পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য সচেষ্ট থাকবে।

অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে তলানিতে পড়ে থাকা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, জলাশয় ভরাট, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও তদারকির ক্ষেত্রে দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট উত্তরণে সরকারের যথেষ্ট চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি আজো দৃশ্যমান নয়।

পরিবেশ দূষণের সাথে বড় অংকের আর্থিক ক্ষতিও যে যুক্ত তার একটি দৃষ্টান্ত পত্র-পত্রিকার খবর থেকে দেয়া যাক। শিল্প কলকারখানাগুলো এবং ঢাকা ওয়াসা বিভিন্ন এলাকায় যে ৬৮টি স্থান দিয়ে দূষিত বর্জ্য ও দূষিত পানি সরাসরি বুড়িগঙ্গাতে ফেলছে তার মধ্যে ৫৬টিই ওয়াসার সুয়ারেজ লাইন। বুড়িগঙ্গার এই দূষণের কারণে ঢাকা ওয়াসাকে ঢাকা শহরের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য মুন্সিগঞ্জ থেকে পদ্মার পানি শোধন করে ঢাকায় আনতে হচ্ছে, যার প্রকল্প ব্যয় কয়েক হাজার কোটি টাকা।

আজ যদি ঢাকাকে ছুঁয়ে থাকা বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত রাখা যেত, তাহলে অনেক দূর থেকে বিপুল অর্থ ব্যয় করে পানি আনতে হতো না। এই হাজার হাজার কোটি টাকাই বুড়িগঙ্গা দূষণের আর্থিক ক্ষতি। আইকিউএয়ার-ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট-২০২১ অনুযায়ী বায়ুদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে এবং দূষিত রাজধানীর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা।

বায়ুদূষণের কারণে দেশে মারা যাচ্ছে লক্ষাধিক মানুষ। শিল্প এলাকার মাটিতে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে মারাত্মক ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম। রাসায়নিক সারের অতি ব্যবহারে খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে বিষাক্ত ক্যাডমিয়াম। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা বলছে-ঢাকায় সিসাদূষণের শিকার ৬ লাখ মানুষ।

উন্নয়নের মডেল হতে যাওয়া বাংলাদেশের খাবারে বিষ, ফসলে বিষ, লিভারে, কিডনিতে, ফুসফুসে, পাকস্থলিতে নির্বিঘ্নে বাস করছে প্রাণঘাতী বিষ। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের এক গবেষণা দেখিয়েছে- বাংলাদেশের প্রায় ২৮ শতাংশ মৃত্যুর জন্য বিভিন্ন দূষণের কারণে সৃষ্ট রোগগুলো দায়ী, যা দক্ষিণ এশিয়াতে সর্বোচ্চ।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়- উন্নত বিশ্বের প্রায় ৫৮ শতাংশ ক্রেতা পণ্য কেনার সময় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের উপর প্রভাবকে বিবেচনায় নেয়। আমাদের রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগের বেশি আসে যে তৈরি পোশাক থেকে, সেখানেও থাকে তাদের পরিবেশ বিবেচনা।

এটিই বলে দেয়-উন্নয়নের সকল কর্মই হতে হবে পরিবেশবান্ধব। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে সৌর, বায়ু, বায়োগ্যাস ও বর্জ্য থেকে। যেমন- দক্ষিণ কোরিয়ায় খাদ্যবর্জ্যরে প্রায় পুরোটা দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।

আর আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেলেও তার মধ্যে সৌর ও বায়ু মিলিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ৫০০ মেগাওয়াটেরও কম। সুইডেন তাদের রিসাইক্লিং কারখানাগুলো সচল রাখতে দেশের বাইরে থেকে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য আমদানি করে থাকে। ইউরোপ জুড়ে কাগজ, প্লাষ্টিক, মেটাল আর গ্লাস রিসাইক্লিং খাতে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে- মৌমাছি আর বাদুড়ের বাঁচা মরার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৭৫ ভাগ শস্যের পরাগায়ন, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ক্ষতিকর পার্টিকেল ও সিসার উপর নির্ভর করছে নাগরিক জীবনের সুস্থতা।

অনুজীবগুলো মারা গেলে, মাছগুলো পলিথিন খেলে, বৃক্ষের অভাবে বায়ুমন্ডলে কার্বন- ডাই অক্সাইড বেড়ে গেলে আমাদের বেঁচে থাকাই একসময় কঠিন হয়ে পড়বে। ষ্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফরেষ্ট-২০১৬ বলছে-বিশ্বের ১৭টি দেশে কৃষিজমি ও বনভূমি দুই-ই কমেছে মারাত্মক হারে।

আর সেই তালিকায় বাংলাদেশের নাম সবার শীর্ষে। গত এপ্রিলে সারাদেশে যে ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বয়ে গিয়ে মানুষ ও জীবজন্তুকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল তার কারণ প্রধানত পর্যাপ্ত সবুজায়ন না করা আর নদী খাল জলাশয় ভরাট করে বায়ু ও মাটিকে শুষ্ক করে ফেলা।

এ প্রেক্ষাপটে এদেশের প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে সুস্থ জীবন যাপন করতে পানি, বায়ু, শব্দদূষণরোধ, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, বেশি করে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে ব্যাপক সবুজায়ন, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন বর্জ্য, ই-বর্জ্যকে রিসাইক্লিনিং এর মাধ্যমে তৈরিকৃত পণ্য পুনঃব্যবহার, বর্জ্য ও সূর্যালোক থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, নদীখাল বিল পুনঃখনন করে সেগুলোতে পানি প্রবাহমান রাখা ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরির মাধ্যমেই কেবল দেশে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখকঃ কবি, কথাশিল্পী ও কলামিষ্ট

raahman.wahid1956@gmail.com

01711-055281

 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS