ভিডিও

একটি আইসক্রিমের মূল্য চার কোটি টাকা

এড. মোঃ মোজাম্মেল হক

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৪, ০৮:৪৫ রাত
আপডেট: জুন ২৪, ২০২৪, ০৮:৪৫ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

গোটা দেশে পর্যায়ক্রমে স্থানীয় সরকারের অধিনে উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। নির্বাচনে কত পার্সেন্ট ভোটার ভোট দিচ্ছে সে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এবারের নির্বাচনে বিরোধী দলতো বটেই সরকারের মিত্র দলগুলোও সেভাবে অংশ নিচ্ছে না।

যদিও এই বছর সরকার দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করছে না, কারণ বিরোধী দল যেহেতু এই সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধিনে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে তাই নির্বাচনে অধিক সংখ্যক প্রার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্যে সরকারি দল দলীয় ব্যানারে ভোট না করে।

ভোট সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, কিন্তু তাতেও কোন ফল হচ্ছে না, কোন ছোট-খাটো দলতো নয়ই নির্দলীয় কোন লোকও এই নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষেরই ভোটের উপর অনীহা ও অভক্তি এসে গেছে, কারণ ভোট স্বচ্ছ হয় এবং ভোটে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে অধিকাংশ মানুষ একথা আর এখন বিশ্বাস করে না।

তারা মনে করে সরকার যাকে নির্বাচিত করবে তাকে ভোট না দিলেও সে নির্বাচিত হবেই, সুতরাং ভোট দিয়ে কি হবে, অথচ এই দেশটা স্বাধীন হলো যতগুলো কারণে তার মধ্যে ভোটের কারণ অন্যতম, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে যদি পাক হানাদার সরকার সে সময় ক্ষমতা হস্তান্তর করতো তাহলে আজ বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।

ভোটের কারণে স্বাধীনতার ডাক আসে, শুরু হয় যুদ্ধ, যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ শহীদ হন এবং তিন লক্ষ মা-বোন ইজ্জত দেন, অথচ এখন সাধারণ মানুষের কাছে ভোট একটা খেলো খেলো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৫/২০ বছর আগেও এই স্থানীয় সরকারের ভোটটি ছিলো একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী অর্থবহ প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যম।

আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গ্রামের শিক্ষিত মুরুব্বি অথবা কোন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারি বা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল টিচার স্থানীয় সরকার ভোটে প্রার্থী হতো। সবাই মিলে ঐ প্রার্থীকে ভোটে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করে ভোটে দাঁড়াতে রাজি করাতো তাও ভোটের সব খরচা গ্রামবাসী নিজেরাই হারি-চাঁদা করে মিটাইতো, অবশ্য এখনকার মতো তখন  এতো টাকা ভোটে খরচ হতো না।

তখন কালো টাকার দৌরাত্ম্যও কম ছিলো, এখনকার মতো তখন ভোট কিনতে হতো না, শুধুমাত্র প্রচার প্রচারণার জন্যে পান বিড়ি সিগারেটের জন্য যেটুকু খরচ হতো তাই খরচ করতো। সেই সময় গ্রামগঞ্জে ভোটের কি উৎসব মূখর পরিবেশ তৈরি হতো চিন্তাই করা যায় না, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভোটের সেই সুন্দর পরিবেশটা একেবারে শেষ হয়ে গেল। শান্তিপ্রিয় পরিবেশের পরিবর্তে বর্তমানে ভোটের মাঠে কালো টাকা আর পেশী শক্তির ভয়ার্ত নির্বাচনী পরিবেশ বিরাজমান।

যার কালো টাকা এবং পেশীশক্তি এবং দলীয় সাপোর্ট আছে তিনিই ভোটে জয়লাভ করেন। জয়লাভ বলা যাবে না অনেক ক্ষেত্রেই তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়, ফলে এখন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে ভোট মানে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়া কারণ ভোটে সাধারণ জনগণের আশা আকাঙ্খার কোন প্রতিফলন হয় না, বরং জনগণের সঙ্গে ভোট নামে তামাশা করা হয়, যদিও দন্তহীন ব্যাঘ্র নির্বাচন কমিশন বার বার ঘোষণা করছে ভোট হবে নিরপেক্ষ, যার ভোট সেই দিবে এবং ভোটে কোন কারচুপি হবে না, তারপরেও জনগণ নির্বাচন কমিশনকে আর বিশ্বাস করে না।

এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। বাসের হেলপার যাত্রীদের ডাকছে ভাই আসেন, আসেন একেবারে বিরতিহীন বাস, রাস্তায় কোথাও থামবে না, একেবারে গন্তব্যে গিয়ে থামবে, এভাবে যাত্রীদের উঠিয়ে তাদের জিম্মি করে রাস্তায় যেখানে পায় সেখানেই যাত্রী উঠায়, যাত্রীরা আর বাসে উঠতে চায় না। যাত্রীরা যখন বাসে উঠতে না চায় তখন হেলপার নতুন করে আবার ভ্যাস ধরে, বলে আসেন ভাই আসেন, একেবারে গেটলক, কোথাও বাস থামবে না, যাত্রীরা আবার বোকা বনে যায়, তারা সরল মনে আবার বাসে উঠে, কিন্তু বিধি বাম, রাস্তার মধ্যে যাত্রী পেলেই হেলপার ড্রাইভার বাস থামিয়ে আবার যাত্রী উঠায়, ফলে পরের বার যাত্রীরা ঐ বাসে আর উঠতে চায় না।

এবার হেলপার নতুন করে ফন্দি আঁটে, বলে আসেন ভাই আসেন গেটলকে উঠেন কোথাও থামবে না। বার বার যাত্রীরা হেলপারের ধোকায় পড়ে এবার যাত্রীরা বলে, না ভাই আপনারা বলেন এক রকম আর করেন অন্য রকম, গেটলক বলা সত্ত্বেও আপনারা রাস্তার মধ্যে যেখানে সেখানে যাত্রী উঠান আপনাদের কথার কোন দাম নাই, আপনাদের বিশ্বাস করা যায় না, আপনাদের বাসে আর উঠবো না, তখন হেলপার বলে ভাই উঠেন আল্লাহর কসম গেটলক, এবার রাস্তায় আর কোথাও বাস থামবে না, যাত্রীরা বার বার ধোকা খেয়ে হেলপারকে যেমন বিশ্বাস করতে চায় না তেমনি নির্বাচন কমিশনের পুনঃপুনঃ নিশ্চয়তা দেওয়া সত্ত্বেও ভোটাররা আর নির্বাচন কমিশনকে বিশ্বাস করে না, নির্বাচন কমিশন যতই আল্লাহর কসম বলুক  না কেন, তাদের আর কেউ বিশ্বাস করে না।

তবে এবারের ভোট আমরা আর মামারা মিলে করেও ভোটের কোন স্বচ্ছতা আনা যায় নাই, প্রত্যেকটা উপজেলায় একাধিক প্রার্থী ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। অধিকাংশ উপজেলায় আওয়ামী লীগের বা তার কোন অঙ্গ সংগঠনের সভাপতি বনাম সাধারণ সম্পাদক কিংবা এমপির প্রার্থী বনাম দলীয় সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের প্রার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়েছে। পরাজিত প্রার্থীরা সবাই মিলে এক হয়ে ভোট সুষ্ঠু হয় নাই বলে অভিযোগ করছে, তাদের এই অভিযোগ বিরোধী দলের কথাকেই সাপোর্ট করে, কারণ বিরোধী দল বার বার অভিযোগ করছে এই নির্বাচন কমিশনের অধিনে কখনই নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না, তাহলে কি সে কথাই ঠিক কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই।

আজকে আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী যদি বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় নাই তাহলে কি ধরে নেয়া যায় না বিরোধী দলের অভিযোগটাই কি সত্যি ছিলো না ? যাক আসল কথায় আসা যাক। গত ৭ই জুন জাতীয় দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় একটি খবর ছাপা হয় আর তাহলো ব্যালটে প্রতীক ভুল, পুনঃনির্বাচনে ক্ষতি চার কোটি টাকা। মানবজমিনের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি প্রতীক ওমর রিপোর্টটা করেছেন। রিপোর্টটা ছিলো এই রকম গত ২৯শে মে দেশের বিভিন্ন উপজেলার ন্যায় বগুড়া সদর উপজেলায় ভোট গ্রহণ চলছিলো।

পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ইফতারুল ইসলাম মামুন ভোট গ্রহণের মাঝপথে অভিযোগ তোলেন প্রতীক বরাদ্দের দিন তাকে কাঠিওয়ালা আইসক্রিমের ছবি দেয়া হয়, সেই প্রতীক নিয়েই তিনি প্রচারণা চালান কিন্তু ভোট শুরু হওয়ার পর দেখা যায় তার নামে বরাদ্দকৃত প্রতীকের সঙ্গে ব্যালট পেপারের প্রতীকের মিল নাই। ব্যালট পেপারে যে আইসক্রিমের ছবি দেয়া হয়েছে সেটা কুলফি আইসক্রিম। ফলে তার ভোটাররা কাঠিওয়ালা আইসক্রিমের ছবি খুঁজে না পাওয়ায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়।

প্রার্থী উপায়ন্তর না পেয়ে অভিযোগ করলে বেলা এগারটার পর নির্বাচন কমিশন থেকে ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) এর ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেয়। রিপোর্টটি সাংবাদিক ঐ ভোটে চার কোটি টাকা খরচের হিসাব দিয়েছেন অর্থাৎ বিগত ২৯শে মে ভোটে প্রায় চার কোটি টাকা সরকারি খরচ হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে কিংবা স্থানীয় নির্বাচন অফিস কিংবা রিটার্নিং অফিসার এই সংবাদের কোন প্রতিবাদ করে নাই, ফলে নিশ্চিতভাবে ধরেই নেয়া যায় ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপে সত্য।

নির্বাচন অফিস থেকে জানা গেছে মোট ভোটের মাত্র ২০% লোক সেখানে ভোট দিয়েছে, এই ভোটের জন্যে সরকারি কোষাগার থেকে চার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যানের ভোট করতে আবার নির্বাচন কাজে নিয়োজিত সকল কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করতে হবে ফলে একই পরিমাণ টাকা আবার খরচ করতে হবে। ফলে সরকারি কোষাগার থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয়ের দায়-দায়িত্ব কে নেবে? সরকারি কাজে গাফিলতি একটি মারাত্মক অপরাধ।

যে সকল কর্মকর্তা কর্মচারী এই ব্যালট পেপার ছাপানোর সঙ্গে জড়িত ছিলো এবং যারা তদারকি কাজে জড়িত ছিলো তারা কেউই এই দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সাধারণ জনগণের টাকা নষ্ট করার অধিকার তাদের নাই। আমাদের দেশে অপরাধ  করতে করতে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে কেউ আর অপরাধকে অপরাধই মনে করে না। যদি অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা থাকতো তাহলে তারা হেলাফেলা করে এই রকম একটি ত্রুটিপূর্ণ কাজ করে সরকারি অর্থ নষ্ট করার সাহস পেত না।

যেহেতু আমাদের কৃতকর্মের জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না সেহেতু সরকারি মাল দরিয়ায় ঢাললেও কোন কৈফিয়ত দিতে হয় না। আমরা কবে দায়িত্বশীল হবো, কবে আমাদের বোধোদয় হবে আমরা ভেবে পাই না। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল, আশির দশকে ইংল্যান্ডে টর্টের একটি মামলা দায়ের হয়েছিলো। টর্ট শব্দের অর্থ কাজে গাফিলতি করা। ঘটনাটি ছিলো এই রকম, এক চোর এক বাড়িতে রাত্রিবেলায় চুরি করতে গিয়েছিলো।

গৃহকর্তার বাড়ি উঁচু প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিলো, কোনভাবেই চোর বাড়িতে উঠতে পারছিলো না। বাড়ির বাহিরে দেয়ালের সাথে একটি পানির ট্যাপ ছিলো যেটা দিয়ে বাড়ির কাজের লোকগুলো হাতমুখ ধুতো। কোন বুদ্ধি না পেয়ে অবশেষে চোর ঐ ট্যাপের উপর পা দিয়ে প্রাচীর টপকাইতে গিয়ে ট্যাপ ভেঙ্গে পড়ে চোরের পা ভেঙ্গে যায়। চোর কোন রকমে সেখান থেকে গিয়ে চিকিৎসা করে আদালতে গিয়ে গৃহকর্তার বিরুদ্ধে এই মর্মে মামলা করেন যে, আমি চুরি করতে গিয়েছিলাম, চুরি করতে পারি নাই, চুরির উদ্যোগ নেয়ার যে শাস্তি তা আমি মাথা পেতে নিবো কিন্তু আমার যে পা ভেঙ্গে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলাম আমার ক্ষতিপূরণ কে দিবে।

টর্টের ঐ মামলায় চোর জয়লাভ করে এবং বাড়ির মালিক চোরকে ক্ষতিপূরণ দেয়, অথচ আমাদের দেশে বড় ধরনের অপরাধ করলেও তার কোন শাস্তি হয় না। বগুড়ার মাঠে-ঘাটে লোকজন বলাবলি করছে তাহলে কাঠিওয়ালা একটি আইসক্রিমের দাম চার কোটি টাকা? জনগণের এই টাকা অপচয়ের শাস্তি হওয়া জরুরি।


লেখক:  সাবেক সাধারণ সম্পাদক
বগুড়া জেলা এ্যাডভোকেটস্ বার সমিতি।

01711-197719



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS