ভিডিও

রাসেলস ভাইপার এবং প্রাণঘাতী প্রাণি

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: জুলাই ০২, ২০২৪, ০৬:২০ বিকাল
আপডেট: জুলাই ০২, ২০২৪, ০৬:২০ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

ইদানিং রাসেলস ভাইপার নিয়ে দেশে একটা হুলস্থুল পড়ে গেছে। সামাজিক মাধ্যম থেকে মহান জাতীয় সংসদ পর্যন্ত এর আলোচনা চলছে। চলছে নানান ধরনের বক্তব্য। সোস্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া সাপের ভয়াবহতাও ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এই সাপটি ডেবুইয়া রাসেলি প্রজাতির বিষাক্ত সাপ। এই সাপটি স্থলে বসবাসকারী রেপটাইল যা ভাইপেরাইডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।

এই সাপের বাসস্থান তার খাদ্যাধিক্যের স্থানেই হয়। অর্থাৎ যেখানে তাদের খাবারের প্রাচুর্যতা থাকে সেখানেই বেশী থাকে। এই সাপের খাদ্য তালিকায় আছে প্রধানত ইঁদুর জাতীয় প্রাণি, ছোট পাখী, গিরিগিটি বা টিকটিকি, ব্যাঙ ও পোকামাকড়।

তাই এই খাবারগুলো যে পরিবেশে বেশী থাকবে রাসেলস ভাইপারও সেই পরিবেশে বেশী থাকবে। সেই বিবেচনায় দানা জাতীয় শস্যের জমিতে বিশেষ করে গম, ভুট্টা ও ধানের জমিতে এই সাপের উপস্থিতি অনেক বেশী হওয়ার কথা।

এক রিপোর্টে দেখা গেছে দানা জাতীয় শস্যের ৭০-৮০% ক্ষতি হয় ইঁদুরের আক্রমণে। তাহলে বুঝতেই পারছেন ইঁদুরের আধিক্যই এই সাপকে শস্যের ক্ষেতে নিয়ে আসার একটি বড় কারণ। ইকোলোক্যিাল ভারসাম্যতার পরিমাপেই এই সাপের সংখ্যাধিক্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যশোর, রাজশাহী, মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় এই সাপের উপস্থিতি স্বাভাবিক। এতে ভয়ের তেমন কিছু নেই। তবে সচেতনতার বিকল্প নেই।

ডিসকভারী ওয়াইল্ড লাইফ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বের সবচাইতে বিপজ্জনক প্রাণঘাতী প্রাণি সাপের মত এই ভয়ঙ্কর ও বিষধর প্রাণি নয়, বিশাল আকৃতির নীল তিমি, হিংস্র সিংহ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়।

সবচাইতে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী প্রাণি হল মানুষের মৃত্যুর জন্য ঘাতক জীবাণু বহনকারী অতিক্ষুদ্র পতঙ্গ মশা। সাপের বিষাক্ততায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এই প্রাণির বিপজ্জনক অবস্থান হলো ৩য় স্থানে। গবেষণায় দেখা গেছে সাপের দংশনের বিষক্রিয়ায় বছরে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার লোক বিশ্বে মারা যায়। আর মশার কামড়ে প্রতি বছর বিশ্বে মারা যায় ৭ লক্ষ ২৫ হাজার মানুষ।

বাংলাদেশে এক জরিপে দেখা যায় ২০১৩ সাল হতে ২০২৪ সালের ৭ই জুন পর্যন্ত ২৩৫ জন রোগী রাসেলস ভাইপারের দংশনে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয় এবং তাদের মধ্যে মারা যান ৬৯ জন (২৯.৩৬ শতাংশ)।

আরেক জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে বছরে সাড়ে সাত হাজার লোক সাপের দংশনে মৃত্যুবরণ করেন, যার মধ্যে ১০০জন মারা যান রাসেলস ভাইপারের আক্রমণে। অর্থাৎ সাপের দংশনে মৃত্যু মানুষের ১.৩৩ শতাংশ মৃত্যুবরণ করেন রাসেলস ভাইপারের দংশনে।

একটি মৃত্যুও আমাদের কাম্য নয়। আবার ভয়ঙ্করের নিরিখে গুজবেও কখনও কান দেওয়া যাবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের কাছে সঠিক, তথ্যবহুল ও নির্ভরশীল সংবাদ পরিবেশন করবেন এটাই কাম্য। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বায়োটিক অর্থাৎ জীবন্ত উপাদান এবং এ্যাবায়োটিক বা জড়বস্তুর মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে।

সৃষ্টিকর্তা সকল ফ্যাকটর বিবেচনা করেই এই ভারসাম্যতা প্রদান করেছেন। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, যেকোন একটি উপাদানের তারতম্যের কারণে বাস্তুসংস্থানের ব্যাপক রদবদল ঘটে। প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয় পরিবেশের। একই ধারাবাহিকতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানব জাতির।

এবার আসি রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতিতে প্রকৃতির ভারসাম্য কিভাবে রক্ষা পায় এবং মানুষের কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হয় সেই কথায়। আমাদের দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হল ধান। সাথে রয়েছে গম ও ভুট্টা। সবই দানা জাতীয় শস্য। আগেই বলেছি প্রতিবছর এই দানা জাতীয় শস্যের ৭০-৮০% ক্ষতিই হয় ইঁদুরের আক্রমণে। ইঁদুরের আক্রমণে শস্য দানা অনেক জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়, যা মানুষের শরীরে পরিবাহিত হয় এবং অনেক রোগ ছড়ায়।

রাসেলস ভাইপার এই ইঁদুরের প্রিডেটর হিসাবে কাজ করে। এভাবে আমাদের প্রচুর অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের কারণ হিসাবে রাসেলস ভাইপার কাজ করে। আবার ইঁদুর দমন করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সাথে সাথে, ইঁদুরের দ্বারা পরিবাহিত রোগ প্রতিরোধ করে জনস্বাস্থ্যে ভূমিকা রাখছে। এই নিরীহ প্রজাতির (দেখতে ভয়ঙ্কর) সাপটি ইঁদুরের গর্তেই বাস করে এবং মানুষের ভয়ে মানুষকে দংশন করতে বাধ্য হয়।

 

এই সাপের গায়ের রং মেটে রং-এর হওয়ার কারণে মানুষ অসাবধানতা বসত সাপটির অতি সন্নিকটে পৌঁছালে নিরুপায় হয়েই মানুষকে দংশন করে। যদিও ঘরবাড়ির চেয়ে ঝোপঝাড় ও ক্ষেতের জমিতে এই সাপের আধিক্য দেখা যায়, তাই কৃষক ভাইয়েরা অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করেই নিজেদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পাদন করবেন।

 

নিজেদের প্রটেকশন গ্রহণ সহ, সম্ভাব্য স্থানগুলিতে অবশ্যই লাঠি দিয়ে আলোড়ন তৈরি করার মাধ্যমে অর্থাৎ কোন ঝোপঝাড় বা শস্যের স্তুপের উপর লাঠির আঘাত করে সতর্কভাবে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে গামবুট ও ফুলপ্যাট পরে মাঠে কাজ করবেন। আবার এই সাপ যেহেতু ইঁদুর প্রিয় তাই খাদ্যশস্য মজুদ করার ক্ষেত্রেও কৃষক ভাইদের যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে।

যে ঘরে খাদ্যশস্য মজুদ করবেন সেই ঘরটি বসবাসের জন্য ব্যবহার না করাই শ্রেয়। একই সাথে বস্তায় মজুদকৃত খাদ্যশস্যের ঘরে ইঁদুরের গর্ত হতে সাবধান থাকতে হবে। এই সাপ যেহেতু পানিতে সাঁতার কাটতে পারে এবং পানিতে সাঁতার কেটে এক জেলা হতে অন্য জেলায় আশ্রয় নিতে পারে। সেই জন্য নদী অববাহিকায় বসবাসরত মানুষের মধ্যে পর্যন্ত সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে।

 

যে নদীতে চরাঞ্চল রয়েছে সেখানে বসবাসরত মানুষকে এই সাপের বাসস্থান, প্রজনন ও চরিত্র সম্পর্কে আগে থেকেই সচেতন হতে হবে। সমাজের যতগুলো জন সম্পৃক্ততার প্রতিষ্ঠান আছে তার সব জায়গাতেই এই সাপ সম্পর্কে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ধারণা ও সতর্কতা সৃষ্টি করতে পারলেই গুজব হতে রক্ষা পেয়ে শান্তিময় জীবন যাপন নিশ্চিত হবে। যেমন স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয়ে জনগণকে যথাযথভাবে বুঝিয়ে সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা তৈরি করতে হবে।

 

এই সাপের কামড়ে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয় না বলে ভিকটিমকে অভয় প্রদানের মাধ্যমে অতিদ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ নিতে হবে। রাসেলস ভাইপার দংশনের পর করণীয় ও প্রয়োজনীয় এন্টিভেনম প্রয়োগের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

 

একই সাথে কৃষি, স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র ও বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সমূহ আন্ত:মন্ত্রণালয় সম্পর্কের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততায় এই সমস্যা অতি সহজেই সামাধান করা সম্ভব। এখন বর্ষা মৌসুম চলছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণঘাতী পতঙ্গ মশার প্রজনন স্থল বেড়েই চলছে। রাসেলস ভাইপারের সাথে সাথে ভয়ঙ্কর পতঙ্গ মশার হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য ও নিজের সতর্কতা এবং সম্পৃক্ততা জরুরি।

 

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
মহাখালী, ঢাকা।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS