ভিডিও

মহানবী (সা) এর ঊর্ধ্বলোকে এক অলৌকিক ভ্রমণ

মাও: মো: রায়হানুর রহমান

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪, ০৫:২৮ বিকাল
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪, ০৬:২৭ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, মহাপবিত্র সেই সত্তা যিনি তার বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত- যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা বনী ইসরাইল : ১)। এখানে আসরা- শব্দের অর্থ রাত্রীকালিন ভ্রমণ।

মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণকে বলা হয় ইসরা। আর বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে সাতআসমান ও আরশ পর্যন্ত যে ভ্রমণ তাকে বলা হয় মি’রাজ। (তাফ: মা’রেফুল কুরআন : ৭৬৪ পৃষ্ঠা)। হাদিসে ব্যবহৃত ‘উরিজা বী’ শব্দ থেকে মি’রাজ শব্দটি এসেছে। অনেকের মতে, নবুওয়াতের একাদশ বর্ষে রজব মাসের ২৭ তারিখে (রাসূলুল্লাহ (সা) এর একান্ন বছর ন’মাস বয়সে) মি’রাজের ঘটনা ঘটে। (সূত্র: ফাতাওয়া ও মাসাইল : ৩১২ পৃষ্ঠা)।

মি’রাজের ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনা : আনাস (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, একদিন আমি কাবা শরিফের কাছে (হাতীমে) নিদ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থায় ছিলাম। তখন জিব্রাইল (আ) অবতরণ করে আমার বক্ষ (বুক থেকে পেটের নিচ পর্যন্ত) চিরিয়া ফেলিলেন। তারপর আমার হৃদপিন্ডটি বের করে তা জমজমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন এবং তা পুনঃস্থাপন করলেন।

অতঃপর জ্ঞান ও ঈমানে আমার অন্তর পূর্ণ করে  দিলেন। তারপর আমার সামনে ‘বোরাক’ আনা হল। সেটা শ্বেত বর্ণের লম্বা কায়াবিশিষ্ট একটি জানোয়ার, যা গাধার চেয়ে বড় এবং খচ্চর অপেক্ষা ছোট। সেটার দৃষ্টি যতদূর যেত পা রাখত। আমি তাতে আরোহণ করে বায়তুল মুকাদ্দাসে এসে পৌঁছিলাম  এবং অন্যান্য নবীগণ যেখানে সাওয়ারী বেঁধে রেখেছিলেন, আমিও আমার বাহনকে তথায় বাঁধলাম।

তারপর মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং দু’রাকাত সালাত আদায় করে বের হলাম। (অপর বর্ণনায় : তারপর সালাতের সময় হলে আমি নবীদের সালাতে ইমামতী করলাম)। অতঃপর জিব্রাঈল আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্বলোকে গেলেন এবং আসমান পর্যন্ত পৌছে দ্বার খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি জিব্রাঈল।

জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ সাঃ। বলা হল, তাকে কি আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। সেখানে আমি আদম (আ) কে দেখতে পেলাম। জিব্রাঈল (আ) বললেন, ইনি আপনার আদি পিতা আদম, তাকে সালাম করুন। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি সালামের জবাব দিলেন। (অপর বর্ণনা মতে: রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আমরা প্রবেশ করে দেখি এক ব্যক্তি বসে আছে যার ডানে-বামে অনেক লোক।

তিনি ডান দিকে দেখে হাসেন আর বাম দিকে দেখে কাঁদেন। আমি জিব্রাইল (আ) কে বললাম, ইনি কে? তিনি বললেন ইনি আদম (আ), আর এ লোকগুলো তার বংশধর। ডান দিকের লোকেরা হচ্ছে জান্নাতবাসী আর বাম দিকের লোকগুলো হচ্ছে জাহান্নামবাসী। আর এ কারণেই তিনি ডান দিকে দেখে হাসেন আর বাম দিকে দেখে কাঁদেন)। তিনি আমাকে মুবারকবাদ জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন। তারপর জিব্রাঈল (আ) আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় আসমানে গেলেন।

সেখানে জিব্রাঈল (আ)  দ্বার খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ সাঃ। বলা হল, তাকে কি আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। সেখানে আমি ঈসা ইবনে মারইয়াম এবং ইয়াহ্ইয়া ইবনু যাকারিয়া (আ) কে দেখতে পেলাম।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আমি তাদের সালাম করলাম। তারাও সালামের জবাব দিলেন) তারা আমাকে মুবারকবাদ জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন। তারপর জিব্রাঈল (আ) আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানে গেলেন। সেখানে জিব্রাঈল (আ) দ্বার খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ সাঃ।

বলা হল, তাকে কি আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। সেখানে আমি ইউসুফ (আ) কে দেখতে পেলাম, যাকে সমুদয় সৌন্দর্যের অর্ধেক দেওয়া হয়েছিল। তিনি আমাকে মুবারকবাদ জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন। তারপর জিব্রাঈল (আ) আমাকে নিয়ে চতুর্থ আসমানে গেলেন।

সেখানে জিব্রাঈল (আ) দ্বার খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ সাঃ। বলা হল, তাকে কি আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। সেখানে ইদরীস (আ) এর দেখা পেলাম। তিনি আমাকে মুবারকবাদ জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন। তারপর জিব্রাঈল (আ) আমাকে নিয়ে পঞ্চম আসমানে গেলেন।

সেখানে জিব্রাঈল (আ) দ্বার খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ সাঃ। বলা হল, তাকে কি আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। সেখানে হারূন (আ) এর দেখা পেলাম। তিনি আমাকে মুবারকবাদ জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন। তারপর জিব্রাঈল (আ) আমাকে নিয়ে ষষ্ঠ আসমানে গেলেন।

সেখানে জিব্রাঈল (আ) দ্বার খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে ? তিনি বললেন, আমি জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ সাঃ। বলা হল, তাকে কি আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। সেখানে আমি মূসা (আ) এর দেখা পেলাম। তিনি আমাকে মুবারকবাদ জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন। তারপর জিব্রাঈল (আ) আমাকে নিয়ে সপ্তম আসমানে গেলেন।

সেখানে জিব্রাঈল (আ) দ্বার খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ সাঃ। বলা হল, তাকে কি আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। সেখানে আমি ইবরাহীম (আ) এর দেখা পেলাম। তিনি বায়তুল মা’মূরের দিকে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন।

বায়তুল মা’মুরে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা তাওয়াফের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেন যারা আর সেখানে পুনরায় ফিরে আসার সুযোগ পান না। তারপর জিব্রাঈল (আ) আমাকে নিয়ে সিদরাতুল মুনতাহায় চলে গেলেন। সে বৃক্ষের পাতাগুলো হাতির কানের ন্যায় আর ফলগুলো বড় বড় মটকার মতো। সে বৃক্ষটির সৌন্দর্য বর্ণনা করা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।

তারপর জিব্রাঈল (আ) আমাকে নিয়ে আরো ঊর্ধে চললেন এবং আমরা এমন এক সমতল ভূমিতে পৌছিলাম, এমন এক স্তরে যেখানে আমি কলমের লেখার খসখস শব্দ শুনতে পেলাম। সেখানে আমি চারটি নহর দেখতে পেলাম : দু’টি প্রকাশ্য আর দু’টি অপ্রকাশ্য। আমি বললাম, হে জিবরীল! এ নহরগুলো কি ? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য নহরদ্বয় তো জান্নাতের নহর আর প্রকাশ্যগুলো হচ্ছে নীলনদ ও ফুরাত নদ। সেখানে আমাকে বেহেশতে প্রবেশ করানো হল।

তথায় ছিল মুক্তার গম্বুজ আর তার মাটি ছিল মিশকের। আমি দেখলাম দোযখের দারোগা মলিককে। সে আগুন প্রজ্জ¦লিত করছে। তারপর জিব্রাঈল (আ) আমাকে একটি শরাবের পাত্র, একটি মধুর পাত্র এবং একটি দুধের পাত্র দিলেন। আমি দুধ গ্রহণ করলাম এবং তা পান করলাম। তিনি বললেন, আপনি ফিতরাতকেই গ্রহণ করেছেন, যদি আপনি শরাব গ্রহণ করতেন তবে আপনার উম্মতগণ সকলে পথভ্রষ্ট হয়ে যেত।

এরপর আল্লাহ তায়ালা আমার উপর যে ওহি করার তা করলেন। আমার উপর দিনরাত মোট পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত  ফরয করলেন। যখন আমি মূসা (আ) এর কাছে ফিরে আসলাম, তিনি আমাকে বললেন আপনার প্রতিপালক আপনার উপর কি ফরয করেছেন? আমি বললাম: পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত। তিনি বললেন আপনার প্রতিপালকের কাছে ফিরে যান এবং একে আরো সহজ করার আবেদন করুন।

কেননা আপনার উম্মত এ নির্দেশ পালনে সক্ষম হবে না। আমি বনী ইসরাঈল কে পরীক্ষা করে দেখেছি এবং তাদের ব্যাপারে এ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, তখন আমি আবার প্রতিপালকের কাছে ফিরে গেলাম এবং বললাম: হে আমার রব! আমার উম্মতের জন্য এ হুকুম সহজ করে দিন। এতে পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হল।

তারপর আমি মূসা (আ) এর কাছে এসে বললাম, পাঁচ ওয়াক্ত কমানো হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত এও পারবে না। আপনি ফিরে যান এবং আরো সহজ করার আবেদন করুন। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, এভাবে আমি একবার মূসা (আ) ও একবার আল্লাহর মাঝে আসা-যাওয়া করতে লাগলাম। (অপর বর্ণনায় : চারবার দশ ওয়াক্ত করে এবং শেষের বার পাঁচ ওয়াক্ত কমানো হয়) শেষে আল্লাহ তায়ালা বললেন, হে মুহাম্মাদ! যাও দিন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নির্ধারণ করা হল।

প্রতি ওয়াক্তে দশ ওয়াক্ত সালাতের সমান সাওয়াব রয়েছে। এভাবে তা (সাওয়াবের দিক থেকে) পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমান। যে ব্যক্তি নেক কাজের নিয়্যাত করল এবং তা কাজে রূপায়িত করতে পারল না, আমি তার জন্য একটি সাওয়াব লিখব; আর তা কাজে পরিণত করলে তার জন্য লিখব দশটি সাওয়াব। (অপর বর্ণনায় : তার জন্য দশ থেকে সাতশ’ গুণ বেশি সাওয়াব লেখা হবে)।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজের নিয়ত করল অথচ তা কাজে পরিণত করল না তার জন্য কোন গুণাহ লেখা হয় না। (অপর বর্ণনায়: তার জন্য বরং একটি নেকী লেখা হয়)। আর তা কাজে পরিণত করলে তার জন্য লেখা হয় একটি মাত্র গুণাহ। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, তারপর আমি মূসা (আ) এর কাছে এসে তাকে তা অবহিত করলাম।

তিনি বললেন, প্রতিপালকের কাছে ফিরে যান এবং বিষয়টি আরো সহজ করার আবেদন করুন। আমি বললাম, এ বিষয়টি নিয়ে আমি বারবার প্রতিপালকের কাছে গিয়েছি, এখন আবার যেতে লজ্জা হচ্ছে। মি’রাজের রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) কে তিনটি জিনিস দেয়া হয়: পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, সূরা বাকারার শেষ কয়েকটি আয়াত এবং যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শিরক না করে মারা যাবে তাদের মাফ করে দেয়ার ওয়াদা। (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম-এ বর্ণিত বিভিন্ন হাদিসের আলোকে সংকলিত)।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের মাধ্যমে পরকালে নাজাতের ব্যবস্থা করুন, আমীন।


লেখক : সহকারী শিক্ষক, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ, বগুড়া

01739-850656



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS