ভিডিও

মাহে রমজানের ফজিলত

মাও: মো: রায়হানুর রহমান

প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৪, ১১:১২ রাত
আপডেট: মার্চ ১৬, ২০২৪, ১২:১৫ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

শুরু হলো পবিত্র রমজান মাস। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুসলমানরা এ মাসটি উদযাপন করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর।

যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা আল বাকারাহ: ১৮৩)। আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের সাওম পালন করবে তার বিগত জীবনের গুণাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারি : ১৮৬৩)। এ মাসেই পবিত্র কুরআন নাযিলের সূচনা হয়। লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে নিয়ে আসা হয় আল-কুরআন।

এরপর সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে মহানবী (সা) এর নাযিল হয় কুরআন মজিদ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, রমজান মাস যাতে নাজিল হয়েছে পবিত্র কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং হেদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। (সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৫)।

রোজাদার হচ্ছে বিশেষ জান্নাতের মেহমান: সহল (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, বেহেশতে রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে, কিয়ামতের দিন রোজাদারেরা সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। রোজাদার ছাড়া আর কেউ এই পথে প্রবেশ করতে পারবে না।

রোজাদারদের ডাকা হবে, রোজাদারেরা কোথায় ? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে এবং সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তারা প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে, যাতে ঐ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে না পারে। (বুখারি : ১৮৫৮, মুসলিম : ২৫৮১, নাসাঈ : ২২৩৫)। দু :খের বিষয় হচ্ছে, এ মাসের অনেক ফজিলত থাকা সত্ত্বেও না জানার কারণে কেউ কেউ সে ফজিলত অর্জন করতে পারে না।

তাই সবাই যাতে রমজান স্বার্থকভাবে উদযাপন করতে পারেন সে জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র লেখা। রমজানকে স্বার্থক করার জন্য নিচের কাজগুলো করতে পারেন। সকল প্রকার মিথ্যা ও পাপাচার পরিহার করুন: রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। তাই রোজাদার অশ্লীল কথা বলবে না, বর্বর আচরণ করবে না এবং কোন লোক তার সাথে ঝগড়া করতে আসলে সে বলবে আমি রোজাদার।

যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার শপথ! রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশক/কস্তুরীর সুগন্ধের চেয়েও উত্তম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোজাদার আমার জন্যই খাদ্য, পানীয় ও কামস্পৃহা বর্জন করে থাকে। তাই রোজা আমার জন্যই এবং আমি নিজেই তার পুরষ্কার দিব। (বুখারি : ১৮৫৬)। আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও তদানুযায়ী কাজ পরিহার করলো না, তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই। (বুখারি : ১৮৬৫, তিরমিযি : ৭০৭)।

উতবা ইবনে ফারক্বাদ (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, রমজানের প্রতি রাতে একজন আহবানকারী ডাক দিয়ে বলে, হে কল্যাণকামীগণ তোমরা নেক কাজ কর। হে পাপীষ্ঠগণ তোমরা পাপ কাজ থেকে বিরত থাকো। (নাসাঈ : ২১০৬, আর আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে, এতে আরো বলা হয়েছে, এ মাসে আল্লাহর পক্ষ থেকে বহু সংখ্যক জাহান্নামীকে মুক্তি দেয়া হয়। তিরমিযি : ৬৮২, ইবনে মাজাহ : ১৬৪২)।

বেশি করে দোআ করুন, কারণ আসমানের (রহমতের) দরজা খুলে দেয়া হয়েছে: আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যখন রমজান মাস আগমন করে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। আর জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর (অবাধ্য) শয়তানদেরকে শিকলে আবদ্ধ করে রাখা হয়। (বুখারি : ১৮৬১, মুসলিম : ২৩৬৬)। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, রোজা পালনকারীর ইফতারের সময়ের দোয়া ফেরত দেওয়া হয়না। (ইবনে মাজাহ : ১৭৫৩)।

পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পাশাপাশি তারাবিহ সালাত আদায় করুন: আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রাতে ক্বিয়াম (তারাবিহ সালাত আদায়) করবে তার বিগত জীবনের গুণাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারি : ১৯৬৫, মুয়াত্তা ইমাম মালিক, কিতা: সালাতু ফী রামাদ্বান : ৩)। লাইলাতুল ক্বাদর অনুসন্ধান করুন: আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে।

রাসুলুল্লাহ (সা) আরো বলেছেন, এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে প্রকৃতই বঞ্চিত হলো। (নাসাঈ : ২১০৫, ইবনে মাজাহ : ১৬৪৪, মিশকাত : ১৯৬২)। আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় ক্বাদরের রাতে ক্বিয়াম (সালাত আদায়) করবে তার বিগত জীবনের গুণাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারি : ১৯৬৮)।

প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত করুন, কেননা এটা সুপারিশকারী হবে: আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, রোজা এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে হে প্রতিপালক! আমি তাকে খাদ্য ও কাম প্রবৃত্তি হতে দিনের বেলা বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল কর। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাত্রিকালে নিদ্রা হতে বিরত রেখেছি।

সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল কর। তখন উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। (বায়হাকী শুআবুল ঈমান, মিশকাত : ১৯৬৩)। আলী (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা)বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করে এবং তা মুখস্ত করে রাখে। এর হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মানে, তাকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার পরিবারের এমন দশজন লোকের জন্য তার সুপারিশ কবুল করবেন, যাদের জাহান্নাম আবশ্যক হয়েছিল (তিরমিযি : ২৯০৫, গরীব,  ইবনে মাজাহ : ২১৬)।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, নিশ্চয়ই এই কুরআন মজিদ সুপারিশ করবে এবং এর সুপারিশ গৃহীত হবে। যে ব্যক্তি তা মেনে চলবে, তা তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি তা থেকে মুখ ফিরে রাখবে, তা তাকে ঘাড় ধরে ঠেলতে ঠেলতে জাহান্নামে ফেলে দিবে। (আবু বক্বর বাযযার, সূত্র: তাফ: ইবনে কাসীর, ১/১৫২ পৃষ্ঠা)। বেশি করে নেক কাজ করুন, কারণ এ মাসে নেকীর প্রতিদান হবে অপরিসীম: রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি আমলের প্রতিদান দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত  বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোজা আমার জন্যই এবং আমি নিজেই তার পুরষ্কার দিব। (মুসলিম : ২৫৭৮, নাসাঈ : ২২১৪)। অন্যকে ইফতার করান: সালমান ফারিসী (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) শা’বান মাসের শেষের দিকে একবার ভাষণ দিলেন, তাতে তিনি বললেন, রমযান মাসে যে অন্যকে ইফতার করাবে এটা তার জন্য গুনাহসমূহের কাফ্ফারা হবে এবং তার নিজেকে জান্নামের আগুন থেকে রক্ষার কারণ হবে এবং তাকে রোজাদারের সমান সাওয়াব দেওয়া হবে।

অথচ তাতে রোজাদারের সাওয়াব কমানো হবে না। এক ব্যক্তি বলল, আমাদের তো প্রত্যেকের ইফতার করানোর সামর্থ্য নাই। রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, আল্লাহ এ সাওয়াব ঐ ব্যক্তিকেও দান করবেন, যে একটি খেজুর বা এক ঢোক পানি দিয়ে ইফতার করায়। আর যে ব্যক্তি রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে, আল্লাহ তাকে আমার হাউজে কাউসার থেকে পানি পান করাবেন।

জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত তার আর পিপাসা লাগবে না। (বায়হাকী শুআবুল ঈমান, মিশকাত : ১৯৬৫)। অধীনস্থদের কাজের চাপ কমিয়ে দিন, যাতে তারা বেশি করে ইবাদত করতে পারে: রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, যে ব্যক্তি এ (রমযান) মাসে দাস-দাসীদের কাজের বোঝা হালকা করে দিবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন। (বায়হাকী শুআবুল ঈমান, মিশকাত : ১৯৬৫)। ভুলেও কোন রোজা বাদ দিবেন না: আবু হুরায়রা (রা) বলেন, যে ব্যক্তি অসুস্থতা বা ওজর ব্যতিরেকে রমজানের একটি রোজাও ভঙ্গ করবে সে সারা জীবন রোজা রাখলেও তার কাজা আদায় হবে না। (বুখারি : কিতাবুস সাওম, অনুচ্ছেদ : ৬৯, আবু দাউদ : ২৩৯৪, তিরমিযি : ৭২৩)।

আবু উমামা বাহেলী (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা) (স্বপ্নেদৃষ্ট ঘটনায়) বলেছেন, তারা আমাকে আরো সামনে নিয়ে গেল এক দুর্গম পাহাড়ের উপর। সেখানে আমি জাহান্নামীদের বিকট ঘেউ ঘেউ আর্তনাদ শুনতে পেলাম। আমরা আরো সামনে গিয়ে দেখলাম, এমন কিছু লোক যাদেরকে হাঁটুতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের চোয়াল ক্ষতবিক্ষত, যা থেকে অবিরত রক্ত ঝরছে। আমি জিজ্ঞেস করলে, তারা আমাকে জানালো যে, এরা সেসব লোক যারা রোজা পূর্ণ হবার আগে ইফতার করত। (নাসাঈ ফিল কুবরা : ৩২৮৬, তাবরানী : ৭৬৬৭, সহীহ ইবনে খুজাইমা : ১৯৮৬ প্রমুখ)।

বাচ্চাদেরও রোজা রাখতে অভ্যস্ত করুন : রুবাঈ বিনতে মুআওয়্যায (রা) বলেন, (রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময়ে), আমরা রোজা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও রোজা রাখাতাম। আমরা তাদেরকে তুলা বা পশমের খেলনা তৈয়ার করে দিতাম। তারা কেউ খাওয়ার জন্য ক্রন্দন করলে আমরা তাকে ওই খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। এভাবে ইফতারের সময় হয়ে যেত। (বুখারি : ১৯১৮, মুসলিম : ২৫৪০)। বেশি বেশি দান-সাদকা করুন : ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, সমগ্র মানব জাতির মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা) সর্বাপেক্ষা দানশীল ছিলেন।

রমজান মাসে জিবরাঈল (আ) যখন তার সাথে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি সর্বাধিক দানশীল হয়ে যেতেন। রমজান মাসে জিবরাঈল (আ) প্রতি রাতেই তার সাথে সাক্ষাত করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা) তার কাছে কুরআন শরীফ পড়ে শুনাতেন। এভাবে জিবরাঈল (আ) যখন তার সাথে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি গতিশীল বায়ুর চেয়েও বেশি দানশীল  হয়ে যেতেন। (বুখারি : ১৮৬৪, নাসাঈ : ২০৯৫)। হতে পারে এটাই আমার/আপনার জীবনের শেষ রমজান। তাই এর প্রতিটি দিনকে নিয়ামত মনে করে ভালো কাজে ব্যয় করুন।


লেখক : সহকারী শিক্ষক
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ, বগুড়া

01739-850656



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS