ভিডিও

লাইলাতুল ক্বদর : হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনি

মোহাম্মদ মোস্তাকিম হোসাইন

প্রকাশিত: এপ্রিল ০৬, ২০২৪, ০৯:১১ রাত
আপডেট: এপ্রিল ০৬, ২০২৪, ১১:২৬ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

বছর ঘুরে ৩৫৪ দিন পর আবারো আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে মহিমান্বিত রজনি লাইলাতুল ক্বদর যা হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ। একটি বছরের মধ্যে সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ যে রাত তার নাম লাইলাতুল ক্বদর। আজ এ বিষয়ে কিছু আলোচনা জ্ঞানী পাঠক সমাজের নিকট উপস্থাপন করার চেষ্টা করব ইন্শাআল্লাহ।

আরবি মাস সমূহের মধ্যে রমজান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। এ মাসটি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় এর সম্মান রয়েছে সর্বোচ্চ। প্রথমত, এ মাসের আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করা; দ্বিতীয়, এ পবিত্র মাসে মানব জাতির মুক্তির নির্দেশিকা পবিত্র কুরআন মাজীদ নাযিল হওয়া; তৃতীয়ত, এ মাসে বিশেষ একটি রাত ‘লাইলাতুল কদর’ বা মহিমান্বিত রজনি হিসেবে ঘোষিত হওয়া।

এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে ইসলামী জীবন বিধানের পরিপূর্ণতা সম্পন্ন হয়েছে। সিয়াম, কুরআন ও লাইলাতুল কদর- একই সূত্রে গাঁথা। ইসলামকে যদি বৃক্ষের সাথে তুলনা করি তাহলে দীন হচ্ছে মূল, কুরআন হচ্ছে কান্ড, রমজান হচ্ছে শাখা আর লাইলাতুল কদর এর প্রশাখা।

আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য রমজান মাসেই কুরআন মাজীদ নাযিলের সূচনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছেঃ রমজান মাস, এ মাসেই মানব জাতির দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য অসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন শরীফ নাযিল হয়েছে। (সূরা বাকারাঃ ১৮৫) অবশ্য এটি রমজানের ৩০ দিনের নাযিল হয়নি বরং একটি মাত্র রাতে অবতীর্ণ হয়েছে।

আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেছেনঃ আমি এটা (কুরআন) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রজনিতে। আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কী জান? মহিমান্বিত রজনি অর্থাৎ লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চাইতে শ্রেষ্ঠ। এই রজনিতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাইল) অবতীর্ণ হয়, প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তি বর্ষিত হয় সেই রজনির ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।- সূরা কদর।

‘কদর’ শব্দটি আরবী। এর এক অর্থ মর্যাদা ও মাহাত্ম্য। এখানে বলা প্রয়োজন, কেন এই রাতটিকে ‘শবে কদর’ বা কদরের রাত বলা হয়? আসলে একজন বান্দা জীবন-সাহারার বিশাল পথ অতিক্রান্ত করেছে, সে প্রভুর দেয়া অগণিত নিআমত ভোগ করেছে; আর জীবন প্রান্তরে উদ্্ভ্রান্তের মতো ছুটাছুটি করে কামিয়ে যাচ্ছে বেশুমার পাপ।

পাপের কলংক মুছে দিচ্ছে তার প্রকৃত অস্তিত্ব। মানবতার কোন চিহ্ন অবশিষ্ট থাকছে না তার জীবন সংসারের কোথাও। পশুজীবনের চাইতেও হতমান এক ঘৃণ্য জীবনের শিকার এখন সে। মানুষ হিসেবে শির দাঁড়াতে পারছে না আর- সে আজ বড় অসহায়।

আর হতমান, লাঞ্ছিত এই অভাগার জীবনেও যদি একটি লাইলাতুল কদর’ এসে দাঁড়ায়; যদি একটি শবে কদরের আহ্বানও ধ্বনিত হয় তার জিন্দগীতে; আর সে যদি সে রাত্রিতে অতীতের কৃত সকল পাপ কর্মের অনুশোচনায় বিগলিত মন নিয়ে, সকল অপরাধ বর্জনের বলিষ্ঠ শপথে প্রত্যয়ী হয়ে, ভাবী জীবনে আর ঘূর্ণাক্ষরেও ঐ সমস্ত পাপ না করার সংকল্পে বদ্ধপরিকর হয়ে, দুচোখে অনুতাপ দগ্ধ অশ্রুবন্যা প্রবাহিত করে হৃদয় খুলে তাওবা করতে পারে; যদি কাটাতে পারে নিখাদ ইবাদত সাধনায় এ-একটি রাত; তাহলেই বদলে যাবে তার এই আঁধার জীবন, এক মহিমান্বিত জীবনে।

আর এভাবেই ‘শবে কদর’ সম্মান ও মর্যাদার রাত্রি- যা একটি হতমান-অসহায় ও অবহেলিত জীবনে এনে দেয় চিরন্তন মর্যাদার প্রবাহ; যেখানে থাকে না তখন আর অপরাধের বিন্দু চিহ্ন। তখন আর বুঝতে কষ্ট হয় না, সত্যিই শবে ক্বদর মহিমান্বিত জীবনের আশ্বাস; সম্মানিত জীবনের পয়গাম, সোনালী তথা উত্তম জীবনের বার্তাবাহক।

একটি হাদীসে আছে, প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন; “যে ব্যক্তি ঈমানের টানে পরকালীন প্রতিদানের আশায় কদরের রাতটি ইবাদত সাধনার মাধ্যমে কাটাবে, তার পূর্ববর্তী জীবনের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হবে।”

আলী ইবনে উরওয়াহ বর্ণনা করেন যে, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম একদিন বনী ইসরাঈলের চারজন নবী হযরত আইয়ুব (আঃ), হযরত যাকারিয়া (আঃ), হযরত হিজকীল (আঃ) এবং হযরত ইউমা ইবনে নুন (আঃ) এদের প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন যে, এঁরা এক একজন বিরামহীনভাবে ৮০ বছর আল্লাহ পাকের ইবাদতে মশগুল ছিলেন এবং চোখের পলক পরিমাণ সময়ের জন্যেও গাফিল থাকেন নি। এ ঘটনা শ্রবণে সাহাবাগণ বিষ্মিত হলেন।

তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) সূরা ক্বদর নিয়ে হাযির হলেন এবং হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের খিদমতে আরজ করলেন, “যেহেতু আপনার উম্মত তাঁদের আশি বছরের ইবাদতের জন্যে আফসোস করছে, সুতরাং আল্লাহ পাক আপনাকে এমন একটি রাত প্রদান করলেন, যে রাতে ইবাদত করলে তা আশি বছর ইবাদতের চাইতে উত্তম হবে।” এরপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) সূরা কদর হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে পড়ে শোনালেন।

আবু বকর ইবনে ওয়ররাক বর্ণনা করেন যে, হযরত সুলায়মান (আঃ) এর বাদশাহীর সময়সীমা ছিল পাঁচশত মাস আর  জুলকারনাইনের বাদশাহীর সময়সীমাও ছিল পাঁচশত মাস। আল্লাহ পাক এ উম্মতকে লায়লাতুল কদর দান করে ইরশাদ করেছেনঃ এ রাতের ইবাদতের সওয়াবের পরিমাণ হবে এ দুই বাদশাহীর একত্রিত সময়সীমার (অর্থাৎ এক হাজার মাস) ইবাদতের চাইতেও অধিক।

উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত। একদিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর হুজুরা শরীফ থেকে আগমন করেছেন। তিনি আমাদেরকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বর্ণনা করার উদ্দেশ্যেই বের হয়েছিলেন। কিন্তু তখন দু’জন মুসলিম একটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া করছিল।

পৌঁছেই তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানানোর উদ্দ্যেশ্যই বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ঝগড়া করছিল। তাই নির্দিষ্ট তারিখটি আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত এটা তোমাদের জন্য ভালই হয়েছে। এখন তোমরা রমজানের শেষ দশকের নবম, সপ্তম ও পঞ্চম রাতে তা খোঁজ কর। (বুখারি শরীফ)

হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত সমূহে ‘লাইলাতুল কদর’ অনুসন্ধান কর। (বুখারি শরীফ)

তবে সাহাবায়ে কিরাম ও ইমামগণ এ ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণা করেছেন। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) থেকে বর্ণীত হাদীস থেকে জানা যায়- লাইলাতুল কদর হচ্ছে ২৭শে রমজানের রাত। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) ও অন্যান্য ‘লাইলাতুল কদর’ ২৭ রমজানের রাতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁরা একটি সূক্ষè বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করেছেন।

তাহলো সূরা কদরের লাইলাতুল কদর তিনবার উল্লেখ হয়েছে। আরবিতে লাইলাতুল কদর লিখতে নয়টি বর্ণ প্রয়োজন। সুতরাং ৩   ৯=২৭ অর্থাৎ ২৭শে রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সে হিসেবে আমাদের মধ্যে (২৭শে রমজান) ২৬ রমজানের দিবাগত রাত ‘লাইলাতুল কদর’ হিসেবে বহুল ভাবে প্রচলিত। হয়তো আল্লাহ্ তা’আলা কোটি কোটি মুসলমানের ধারণা অনুযায়ী উক্ত তারিখে ‘লাইলাতুল কদর’ কে লুক্কায়িত রেখেছেন। যা হাদিসের মর্মানুযায়ী যথার্থ।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর আরেকটি বিবরণ দ্বারা জানা যায় যে, তকদীরের সিদ্ধান্ত শবে বরাতে গৃহীত হয় তবে সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের নিকট লায়লাতুল কদরে তা’ কার্যকর করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। প্রখ্যাত তফসীরকার আল্লামা আলুসী এ সম্পর্কে বলেছেনঃ মূলত এখানে তিনটি স্বতন্ত্র কাজ রয়েছে। প্রথম কাজ হলো, তকদীর নির্দিষ্ট হওয়া, অর্থাৎ কখন কি ঘটবে? কিভাবে ঘটবে? এর সিদ্ধান্ত আল্লাহ পাক আসমান-জমীন সৃষ্টির পূর্বেই গ্রহণ করেছেন।

দ্বিতীয় কাজ হলো তকদীর সমূহকে লওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ করে ফেরেশতাদের নিকট প্রকাশ করা। এ কাজটি শবে বরাতে সম্পন্ন হয়ে থাকে। আর তৃতীয় কাজ সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদেরকে এ তকদীরসমূহের বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পণ করা। আর এ কাজটি লায়লাতুল কদরে হয়ে থাকে।

হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রাঃ) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুনিয়াতুত তালেবীনে’ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীস সংকলন করেছেন । তিনি বলেছেন ‘লাইলাতুল কদরে’ আল্লাহ্ তা’আলা জিবরাঈল (আঃ)- কে সিদরাতুল মুনতাহার সত্তর হাজার ফেরেশতা নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করার নির্দেশ দেন।

তখন জিবরাঈল (আঃ) নির্দেশ মোতাবেক ফেরেশতাদের দল নিয়ে নূরের পতাকাসহ যমীনে আগমন করেন। পৃথিবীর চারটি জায়গায় সেই পতাকা উত্তোলন করেন। (১) বায়তুল্লাহ্ বা কা’বা শরীফ, (২) বায়তুল মোকাদ্দাস, (৩) মসজিদে নববী ও (৪) তূরে সীনা মসজিদে। এরপর ফেরেশতাগণ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন । প্রত্যেক মু’মিন নারী- পুরুষের (ইবাদতরত) ঘরে প্রবেশ করেন এবং উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অবশ্য যে সব ঘরে কুকুর, শূকর, প্রাণীর ছবি, মদ্যপায়ী, যেনাকারী, সুদখোর ব্যক্তি থাকে সে সব ঘরে ফেরেশতারা প্রবেশ করেন না ।”

এ রাতের দোয়া ও করণীয় সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন “আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ! আমি যখন লাইলাতুল কদর পাবো, তখন কি দোয়া করব? রাসূলাল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করলেন “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা “আফুউবুন, তুহিব্বুল “আফওয়া, ফা’ফু আন্নী। অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি  মহিয়ান, ক্ষমাশীল। ক্ষমা করাটা তুমি ভালোবাসো । তাই তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

হাদীস শরীফে আছে, রাসূল (সাঃ) লাইলাতুল  কদর সম্পর্কে বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে আখিরাতের মুক্তির আশায় কদরের রাতটি ইবাদতে কাটাবে, আল্লাহ্ তা’আলা তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। “তাই রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এ রাতে তাঁর পরিবারের লোকজনকে জাগিয়ে তুলতেন । আর কবর যিয়ারত করতেন । সাহাবায়ে কিরাম তাঁর অনুসরণ করতেন।

এ রাতেই যেহেতু কুরআন মাজীদ নাযিল শুরু হয়েছে তাই তিলাওয়াতে কুরআনও বিশেষ সওয়াবের মাধ্যম। নফল নামায, যিকির-আযকারের মাধ্যমে রাতটি অতিবাহিত করতে পারলে অশেষ সওয়াব পাওয়া যায় । আল্লাহ্ তা’আলা চান বান্দা তার গুনাহ্র জন্য অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করুক, তিনি তা কবুল করবেন তাই এই মহিমান্বিত রজনির রহমত লাভ করতে হলে প্রত্যেক মু’মিনকে খালেস নিয়তে তওবা-ইস্তিগফার পড়ে আল্লাহ্ রাব্বুল ইযযতের দরবারে হাজিরা দেওয়া উচিত।

তাহলে এই মহান রাতের ফযীলত ও বরকত নসীব হবে। লাভ করতে পারবে মাগফিরাত। কিন্তু আফসোস হচ্ছে যদি প্রকৃত সত্যটি উপলব্ধি করতে পারতাম তাহলে তো একটি শবে ক্বদর-ই আমাদের জীবন ভরে দিতে পারতো অফুরন্ত কল্যাণ ধারায়। অর্জিত হতো দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় সমস্যার শান্তিপ্রিয় সমাধান । হে আল্লাহ্ তুমি আমাদের কে তোমার হিদায়ত দান কর।

আমিন, ছুম্মা আমিন।
লেখক : প্রভাষক-কলামিষ্ট, ইসলামি গবেষক



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS