ভিডিও

বগুড়ায় ২২ দিনে তিন জোড়া খুন, জনমনে আতংক

সিরিজ খুনোখুনি থামছেই না 

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৪, ১১:০৮ রাত
আপডেট: জুন ২৫, ২০২৪, ০৭:৩৮ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

মাসুদুর রহমান রানা : বগুড়ায় খুনোখুনি থামছেই না। সিরিজ খুনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। একটি খুনের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি খুনের ঘটনা ঘটছে। জোড়ায়, জোড়ায় খুনের ঘটনায় মানুষ চরম আতংকিত। চলতি জুন মাসের ২২ দিনেই বগুড়ায় তিন জোড়া হত্যাকান্ডসহ ৮টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে।

এমনকি নারীর হাত কেটে কবজি পলিথিনে করে নদীতে ভেসে দেয়া হচ্ছে। সেইসাথে ১১ মাসের শিশুকে জবাই করে সেই মস্তক পলিথিনে ভরে নদীতে ফেলে দেয়া হচ্ছে। আতংকের জনপদে পরিণত হয়েছে বগুড়া। খুনোখুনি বাড়লেও খুনের মামলাগুলোর তদন্তে তেমন অগ্রগতি নেই। গ্রেপ্তার হচ্ছে খুব কম সংখ্যক আসামি। অধিকাংশ খুনিরা থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

খুনোখুনিতে চরম অবনতি হয়েছে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো: আবু সায়েম বলেন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণে বগুড়ায় বেশি মানুষ খুন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বগুড়ায় অস্থিরতা বেড়েছে। সহনশীলতার অভাবে মানুষ আগ্রাসী হচ্ছে।

সামান্য বিষয় নিয়ে মানুষ মানুষকে মেরে ফেলছে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ নয়, পরিবারে সোহাদ্যপূর্ণ সম্পর্কে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সু-সম্পর্কের অভাব রয়েছে। তাই পরিবারের অস্থিররতার প্রভাব সমাজে এসে পড়ছে।সেইসাথে জমি-জমা নিয়ে বিরোধ, পরকীয়া, অনৈতিক সম্পর্কের জের, মাদক সেবন, অসৎ সঙ্গ ,ও কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্বের জন্য খুন বেড়েছে। অনেক কিশোর-যুবক ভারতীয় সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রল দেখে অনুকরণ করে অপরাধ করতে উৎসাহিত হচ্ছে।

বগুড়া এ্যাডভোকেট বার সমিতির সভাপতি আতাউর রহমান খান (মুক্তা) বলেন, সিরিজ খুনোখুনিতে বগুড়ায় আইন শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। মানুষের নিরাপত্তা বলতে কিছু নাই। আইন শৃংখলা রক্ষায় পুলিশ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সমাজে খুন করে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। রাজনৈতিক প্রভাব ও টাকার জোড়ে আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে খুনিরা।

এ ছাড়া বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে খুনের মত ঘটনা বাড়ছে। একেকটি হত্যা মামলা বিচারকার্য শেষ হতে ৮-১০ বছর লেগে যাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রভাবশালিদের ভয়ে আদালতে সব স্বাক্ষী স্বাক্ষ্য দিতে আসেনা। আদালতের বাইরে স্বাক্ষীরা ম্যানেজও হয়ে যাচ্ছে।

অনেক হত্যা মামলার বাদিও আদালতের বাইরে আপোষ করে থাকে। প্রভাবশালি মহল খুন করে টাকার জোড়ে বাদির সাথে আপোষ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচারহীনতার কারণে খুনি উৎসাহিত হয়ে আবার অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। তিনি বলেন, হত্যা মামলাগুলো দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলে হত্যাকান্ড কমে আসবে।

পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা মনসুর আলী মন্ডল বলেন, বগুড়ায় পুলিশ আইন শৃংখলা রক্ষায় তেমন ভূমিকা পালন করতে পারছেনা। বগুড়া শহরের ফাঁড়িগুলো অপরাধ দমনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারছে না। শহরে আইন শৃংখলা রক্ষায় সদর থানাসহ  ৮টি পুলিশ ফাঁড়ি কাজ করে। কিন্তু তদারকির অভাবে ফাঁড়ি গুলো তেমন কাজ করছে না। যে কারণে খুন ও ব্যাংকে টাকা লুটের মত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

বগুড়ার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ আবু সায়েম বলেন, মনুষের স্বার্থের আঘাত লাগলে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠে খুন করছে। কেউ কাউকে ওপরে উঠতে দিবেনা এই প্রবণতা থেকে মানুষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, অপরাধ নির্মূলে শুধু পুলিশের ওপর নির্ভর না করে সামাজিকভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

তবে এ ব্যাপারে বগুড়ার পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি) সুদীপ  কুমার চক্রবর্তী বলেন, খুন করে কেউ পার পাচ্ছে না। খুনের  ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করা হচ্ছে। ক্লুলেস মামলার রহস্যও উদঘাটিত হচ্ছে।

এদিকে,এক পরিসংখান থেকে জানা গেছে চলতি ১ জুন থেকে ২২ জুন পর্যন্ত ২২ দিনে  বগুড়ায় তিনজোড়া হত্যাকান্ডসহ ৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।  সেইসাথে ১ জানুয়ারি থেকে ২২ জুন পর্যন্ত  ৫ মাস ২২ দিনে বগুড়ায় নারী ও শিশুসহ খুন হয়েছে ৩৩ জন।

সর্বশেষ  জুন মাসের ২২ জুন পর্যন্ত তিনটি জোড়া খুনসহ আরও ৮ জনকে খুন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঈদের দিন গত ১৭ জুুন রাতে প্রাইভেটকারে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে শহরের নিশিন্দারা চকরপাড়ায় জোড়া হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে।

ওই এলাকায় গুলি করে ও কুপিয়ে রুমন ও শরিফ নামে দুই যুবককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেইসাথে গুলিবিদ্ধ হয় হোসাইন ওরফে হোসেন নামে আরও এক যুবক। এই জোড়া হত্যার ঘটনায় ৪ জন ধরা পড়লেও এখনও অধরা আরও ২৪ আসামি।

অপর দিকে, গত ২ জুন বগুড়ার বনানীতে শুভেচ্ছা আবাসিক হোটেলে স্ত্রী আশামনি ও ১১ মাস বয়সী শিশু পুত্র রাফিকে জবাই করে হত্যা করে শিশুটির বাবা আজিজুল। শুধু স্ত্রী সন্তানকে নৃশংসভাবে খুন করেও ক্ষান্ত হয়নি পাষান্ড আজিজুল।

সে ঘটনা ভিন্ন দিকে প্রবাহের জন্য  তার ১১ মাস বয়সী সন্তানের মাথা কেটে পলিথিন ব্যাগে তুলে নিয়ে শহরের চেলোপাড়া রেল ব্রিজের নিচে ফেলেও দেয়। পরে শহরের রেল ব্রিজের কাছে করতোয়া নদীতে ডুবুরি নামিয়ে দিয়েও শিশুটির মস্তক উদ্ধার হয়নি।

আর লোমহর্ষক এই জোড়া খুনের ঘটনা দেশব্যাপী তোলপাড় হয়। পুলিশ আজিজুলকে গ্রেপ্তার করেছে।এদিকে, বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে সাবগ্রামের কুরশা পাড়া এলাকায় একটি কালভার্টের পাশ থেকে আনুমানিক ২৬ বছর বয়সী এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

দুর্বত্তরা তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে মহাসড়ক সংলগ্ন কালভার্টের নিচে পানিতে ডুবিয়ে রাখে। গত ৯ জুন সকালে পুলিশ সেখান থেকে তার লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে।

সেইসাথে একই দিন দিবাগত রাত সোয়া দশটার দিকে কাহালু উপজেলার মুরাইল ইউনিয়নের পোড়াবাড়ি এলাকায় তালুকদার পাড়া রাস্তার মোড়ে সন্ত্রাসীরা বগুড়ার আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ২৯ মামলার আসামি ব্রাজিলকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। রাস্তায় পাশে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা তার মোটর সাইকেলের গতিরোধ করে তাকে কুপিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়।

সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারি রাতে সদরের বালা কৈগাড়ী গ্রামে পিটিয়ে ও ড্রেনের কাদা-পানির মধ্যে চুবিয়ে ইউনূস আলী নামে একজন হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় র‌্যাব ও পুলিশ মোট ২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। একই দিন সকালে শহরের উপকণ্ঠে মাটিডালি এলাকায় ব্রিজের কাছে করতোয়া নদী থকে পলিথিনে রাখা এক নারীর হাতের দুটি কবজি উদ্ধার করে পুলিশ। তবে পুলিশ কবজি দুটি কোন নারীর তা শনাক্ত করতে পারেনি।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS