ভিডিও

বন্ধ হয়ে গেছে তোলাবাজি, চাঁদাবাজি ট্রাফিকিং, বাজার মনিটরিং

সমাজ সংস্কারের কাজ করছে শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৪, ১০:২৭ রাত
আপডেট: আগস্ট ১১, ২০২৪, ০১:০৭ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

নাসিমা সুলতানা ছুটু : বগুড়ার রাজা বাজারে প্রায় ১৫ বছর ধরে সবজি বিক্রি করেন জহুরুল। সদরের শেখেরকোলা গ্রামের জহুরুল গত দুইদিন থেকে বাজারে সবজি নিয়ে ঢুকতে কাউকে কোন চাঁদা দেননি। অথচ তিনদিন আগেও সবজির ভ্যান নিয়ে ঢুকতেই ৭০ টাকা চাঁদা দিতেন তোলাকারীদের হাতে। জহুরুলের দুই দোকান পরেই বিভিন্ন সবজির পসরা নিয়ে বেশ হাসিমুখে বসে আছেন চল্লিশোর্ধ শাহীন।

দীর্ঘদিন থেকে রাজাবাজরে সবজি বিক্রি করেন তিনি। বেশ হাসিখুশি মুখে শাহীন জানান, দুইদিন আগে থেকে ছাত্ররা বাজারে এসে আমাদের বলে গেছেন, আমরা যেন কাউকে চাঁদা বা তোলা না দেই। তারপর থেকে আমাদের কাছে আর কেউ চাঁদা নিতে আসছে না। আজও (শনিবার) তারা জানতে এসেছিলেন আমাদের কাছে কেউ চাঁদা নিতে এসেছেন কী নাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীরা শহর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, দেয়াল লিখন, বাজার মনিটরিং, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরসহ পাড়া-মহল্লা রাত জেগে পাহাড়া দেয়ার মত গুরু দায়িত্ব পালন করছেন।

পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা নিয়েও তারা কাজ করছেন। হেলমেট ছাড়া বাইক আরোহী দেখলে থামিয়ে তাদের হেলমেট পরার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে ট্রাফিকিং’ করতে কোথাও কোথাও জটের সৃষ্টি হচ্ছে বলেও কেউ কেউ দাবি করছেন। এছাড়া একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে যেতে সময় এবং অর্থ দুটোই বেশি গুণতে হচ্ছে বলে কারো কারো অভিযোগ রয়েছে। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষই তাদের কাজের প্রশংসা করছেন।

মাহমুদা, ইয়ামনি, ছুমাইয়া, মনিষা, রাকিব, অয়নসহ প্রায় ১৬জন শিক্ষার্থী বগুড়া বড়গোলায় ট্রাফিকিং এর কাজ করছেন। এদের অধিকাংশই বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটের সদস্য। চলতি এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইয়ামনি জানান, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত একদল কাজ করেন। এরপর দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আরেক দল কাজ করবেন।

তবে ওই রোডের ট্রাফিক কন্ট্রোল ইনচার্জ শেরপুর কলেজের শিক্ষার্থী জুনায়েদ হোসেন জানান, এখানে যারা কাজ করেন, তারা সবাই সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করছেন। একদল যখন ট্রাফিকের কাজ করেন তখন আরেক দল বাজারে গিয়ে বাজার মনিটরিং এর কাজ করছেন বলে জানান। শহরের সাতমাথায় ট্রাফিকের কাজ করছেন প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। সাতমাথা গোলচত্বর পেরিয়ে লোটোর শোরুম থেকে গোল চত্বর পর্যন্ত ট্রাফিকিং করছেন ৫০জন শিক্ষার্থী।

এদের টিম লিডার বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচার এন্ড এক্সপোটার্স এর ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মিথুন জানান, তারা নিজ উদ্যোগে এই কাজ করছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকে ঢাকায় আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে বগুড়ায় এসেছেন। এখন ট্রাফিকিং এর টিম লিডার হিসেবে কাজ করছেন। মানুষ যেন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে, সমাজের কোথাও কোন অসংলগ্ন না থাকে সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বগুড়ার সমন্বয়কদের একজন নিয়তি সরকার নিতু জানান, তালিকা অনুযায়ী ৩৫০জন শিক্ষার্থী বগুড়া পৌরসভার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে এর পাশাপাশি কিছু শিক্ষার্থী নিজ উদ্যোগে মাঠে কাজ করছে। তবে আমরা খুব দ্রুত কাজ বন্টন করে দেব।

ছয় সিটের ইজি বাইক চালক চালক বাচ্চু মিয়া জানান, দীর্ঘদিন ধরে বারোপুর থেকে বড়গোলা মোড় পর্যন্ত তিনি ইজিবাইক চালান। এতোদিন ধরে চাঁদা দিয়ে এলেও গত তিনদিন থেকে কোন চাঁদা দিতে হচ্ছে না। আগে রোডের চাঁদা এবং ট্রাফিকের চাঁদাসহ প্রতিদিন ৫০টাকা দিতে হতো।

ছাত্ররা ট্রাফিকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আর চাঁদা দিতে হচ্ছে না। টিনপট্টি এলাকার ব্যাটারিচালিত ভ্যানচাল রুহুল আমিন জানান, পণ্যবোঝাই ভ্যান নিয়ে কোন এলাকায় গেলেই চাঁদা দিতে হতো। এলাকা ও দূরত্ব ভেদে ৬০ থেকে ১শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিতো চাঁদাবাজরা। আপাততঃ এই পরিস্থিতি থেকে কিছুটা আমরা মুক্ত আছি।

শিক্ষার্থীদের বাজার মনিটরিংয়েও খুব একটা প্রভাব পড়েনি বাজারে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতা। তিনি বলেন, দোকানদারদের চাঁদা দেওয়া হয়তো বন্ধ হয়েছে, কিন্তু দ্রব্যমূল্য তেমন কমেনি। দুই-একটি সবজির দাম হয়তো কিছুটা কমেছে কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। আব্দুল মতিন নামে আরেক ক্রেতা জানান, আলু, পিঁয়াজ, মরিচ, আদা-রসুন আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ এখনও স্বাভাবিক হয়নি বলে হয়তো কমেনি। স্বাভাবিক হলে হয়তো কমতে পারে।

শিক্ষার্থীদের এই কাজকে সাধুবাদ জানিয়ে কলেজ শিক্ষক শামিমা সুলতানা নিভা বলেন, তরুণ প্রজন্ম আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রজন্মের সন্তানের মা হিসেবে আমি নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করি। নারী উদ্যোক্তা এবং এই আন্দোলনের সাথে শুরু থেকে যুক্ত উম্মে ফাতেমা লিসা জানান, আজ কোথাও পুলিশ নেই, কিন্তু এই শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ট্রাফিকের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে কাজ করছে। কাজ করতে গেলে কিছু ভুল হয়তো থাকবে তবে আমরা তাদের ভুল না ধরে শুধরে দেই।

কারণ এই প্রজন্মই আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে মৃত্যুকে বুক পেতে নিতে শিখিয়েছে।  বিশিষ্ট গাইনী চিকিৎসক ও লেখিকা ডাঃ ফাহমিদা নিলা বলেন, আমাদের এই জেনারেশানের (Gen-Z)  বাচ্চারা শিখিয়ে দিল, আত্মসম্মানবোধ কাকে বলে? শিখিয়ে দিয়ে গেল, কীভাবে নিজেদের সম্মান কিভাবে ধরে রাখতে হয়, নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হয়।

তারুণ্যের সাহসিকতা আমরা যুগে যুগেই দেখেছি। কাজেই ধরে নিয়েছিলাম, চব্বিশের জুলাই সেই পুরনো ইতিহাসের একটি ঝলক হয়ে থেকে যাবে হয়তো। কিন্তু না! ওরা থেমে থাকেনি। কাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জনের পরেও ওরা হাল ছাড়েনি। ভাঙাচোরা দেশটাকে ওরা নিজ হাতে পরিষ্কার করেছে, ওরা নিজেদের লেখা প্রতিবাদী দেয়াল মুছে দিয়ে আবারও নতুনভাবে নতুন রঙে রাঙিয়ে চলেছে।

পুলিশের অনুপস্থিতিতে ওরা ট্রাফিক পরিচালনা করছে,কোন প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেনিং ছাড়াই। ওরা রাত জেগে এলাকা পাহারা দিচ্ছে, ডাকাত ধরছে অত্যাধুনিক ড্রোনের সাহায্যে। এ যেন এক নতুন বাংলাদেশ। দিনরাত মোবাইল আর কম্পিউটারে ডুবে থাকা যে বাচ্চাগুলোকে আমরা ডিজিটাল বাংলার পঙ্গু জেনারেশান বলে আফসোস করতাম, সেই বাচ্চারাই আমাদের দেখিয়ে দিল, কিভাবে রাষ্ট্র তথা দেশ সংস্কার করতে হয়। কিভাবে নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নিতে হয়।

বগুড়ার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বজলুর করিম বাহার বলেন, ছাত্ররা যে সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে তা অত্যন্ত ভালো। তবে তারা যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এটা হলে মন্দ হয় না, তবে তাদের মধ্যে যদি আত্মগরিমা চলে আসে সেটা তাদের এই অর্জনকে ম্লান করে দেবে।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS