নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আটকাতে পারেনি খালেদা আখতারকে
নাজমুল হাসান নাহিদ, গুরুদাসপুর (নাটোর) : কিছু মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আটকাতে পারেনি খালেদা আখতারকে (৫৮)। নিজের দৃঢ় মনোবল আর পরিবারের সমর্থন থাকায় সব বাধা ডিঙিয়ে আনসার-ভিডিপি কর্মকর্তা হিসেবে ৩৪ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি। এখন কর্মক্ষেত্র ও পারিবারিকভাবেও সফল তিনি।
খালেদা আখতারের বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরশহরের চাঁচকৈড় কাচারীপাড়া মহল্লায়। তার স্বামী শামসুল হক শেখ শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। এই দম্পত্তির একমাত্র মেয়ে শেখ সাদিয়াতুজ জাহান একজন চিকিৎসক। খালেদা আখতার এখন উপজেলা আনসার-ভিডিপি কর্মকর্তা হিসেবে বড়াইগ্রাম উপজেলায় কর্মরত রয়েছেন। তবে তার চাকরির শুরুটা হয়েছিল প্রশিক্ষক পদে।
একজন নারী হয়ে খাঁকি পোষাক পরে (প্যান্ট-সার্ট) অফিস করা এবং উম্মুক্ত মাঠে নারী- পুরুষ সদস্যদের লাঠি-অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি সহজ ছিলনা বলে জানান খালেদা আখতার। তার ভাষ্যমতে, সমাজের কিছু মানুষ কথায়, ইশারা- ইংগিতেএ নেতিবাচক ভাবে দেখতেন তাকে। অনেক সময় খারাপ লাগলেও দৃঢ় মনোবল আর পারিবারিক সমর্থন শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। এখন পদোন্নতি পেয়ে প্রশিক্ষক থেকে কর্মকর্তা হয়েছেন। একজন সফল মা তিনি। প্রতিদিন মোটরবাইক চালিয়ে বাড়ি থেকে অফিস করেন।
এই নারী কর্মকর্তা বলেন, ছোট বেলা থেকেই খাঁকি পোষাকে কর্মকর্তা পদে চাকরি করার (পুলিশ-সেনাবাহিনী) স্বপ্ন ছিল। ১৯৯০ সালে ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়েই আনসার-ভিডিপি প্রশিক্ষক পদে আবেদন করেছিলেন। যাচাই-বাছাই পরীক্ষায় টিকে যান তিনি। তারপর সফিপুর আনসার একাডেমিতে দীর্ঘ প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করেন। ছেলেদের সাথে তাল মিলিয়ে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান তিনি।
প্রশিক্ষণে সমস্যা না হওয়ার কারণ সম্পর্কে খালেদা আখতার বলেন, খেলাধুলায় পারদর্শি ছিলেন। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় হাইজাম্প, লংজাম্প দৌড়-গোলক নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করেছেন। এজন্য অসংখ্য পুরস্কারও জুটেছে। মূলত: খেলাধুলার চর্চা কাজে দিয়েছে প্রশিক্ষণ ও কর্ম জীবনে।
তিনি আরো জানান, সফিপুর আনসার একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষ করে প্রশিক্ষক হিসেবে গুরুদাসপুর উপজেলায় যোগদান করেছিলেন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মময় জীবনে গুরুদাসপুর উপজেলা জুড়ে ৩২জন নারী ও ৩২জন পুরুষ সদস্যের (একটি করে প্লাটুন) একটি করে দলে ১ হাজার ২৮০ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। প্রশিক্ষণার্থীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করায় কর্তৃপক্ষ তাকে উপজেলা আনসার-ভিডিপি (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তার দায়িত্ব দেন।
২০২০ সালে বড়াইগ্রাম উপজেলায় বদলি হয়ে সেখানে ৫ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৬৪জন) ৩২০জন আনসার সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। প্রশিক্ষিত এসব নারী-পুরুষ সদস্যদের দেশ গঠনে উজ্জীবিত করাসহ সেলাই, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ শাক সবজি উৎপাদন হাঁস মুরগী গরু ছাগল পালনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যক্তি জীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার সুৃযোগ পেয়েছে। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত এসব সদস্যরা কোভিড, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দেশের নানা সংকটে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রশিক্ষক থেকে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান খালেদা আখতার।
আরও পড়ুনদীর্ঘ চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতার বলতে গিয়ে তিনি বলেন,- কর্মক্ষেত্র ও চলতি পথে অনেক মানুষের নেতিবাচক আচরণ, কটাক্ষ করে কথা বলা গা সওয়া হয়ে গেছে। কর্ম জীবনে নিজেকে কখনো নারী হিসেবে দেখিনি। পেশার প্রতি দায়িত্ববোধ কাজ করেছে সব সময়। এ পেশাতে দেশাত্মবোধ ও মানুষের সেবার সুযোগ রয়েছে। এ আত্মতৃপ্তি থেকেই দীর্ঘ বছর চাকরি করে যাচ্ছি। তাছাড়া বাবা ও স্বামীর পরিবার থেকে সবসময় উৎসাহ পেয়েছি। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে অবসরে যাবেন তিনি।
খালেদা আখতার বলেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানা উপসর্গ বাসা বেঁধেছে শরীরে। বিশেষ করে জয়েন্ট ও হাঁটুর হাড়ক্ষয়ে যাওয়ায় অনেক কষ্ট সইতে হচ্ছে। তবু চাকরিটা শেষ করতে চাই ভালোভাবে। তবে শেষ কর্মস্থলটা নিজ উপজেলায় (গুরুদাসপুর) হলে ভালো হয়।
তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন ছিলেন তিনি। পঞ্চম শ্রেণি পাস মা রাজিয়া বেগম গৃহিণী আর বাবা খলিলুর রহমান হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির একটি পদে চাকরি করতেন। রুটিন খরচে চলতো সংসার ও পড়ালেখা। তবে পারিবারিক উদারতা ছিল। একারণে খেলাধুলায় বা আনসার-ভিডিপির চাকরিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। তার তিন ভাইয়ের সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।
১৯৯২ সালে চাকরি করা অবস্থায় পছন্দ করে ব্যবসায়ী শামসুল হক শেখকে বিয়ে করেছিলেন। স্বামীর ইতিবাচক ভূমিকার কারণে চাকরি করছেন স্বাধীনভাবে। তাদের একমাত্র মেয়ে এমবিবিএস পাস করে আল্টাসাউন্ড কোর্স করছেন। এখন সুখের সংসার তাদের।
দেশের তরুণীদের প্রতি তার আহবান, সবার আগে মনের সংকীর্ণতা দূর করতে হবে। যোগ্যতা অনুযায়ী পেশায় অংশ গ্রহণ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ও চলতে হবে। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় অনেকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে। শক্তি সাহস নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছালেই জীবন সুখময় হয়ে উঠবে।
মন্তব্য করুন