মশা ঢুকেছে স্কুলে
ঢাকার ব্যস্ত শহরের মধ্যে ছোট্ট একটা স্কুল, নাম তার সোনামণি বিদ্যা নিকেতন। এই স্কুলটি খুব পরিচিত এলাকার মধ্যে, কারণ এখানে শিশুদের জন্য অনেক সুন্দর পরিবেশে পড়ালেখা করা হয়। কিন্তু আজকে স্কুলে সবাই বেশ আতঙ্কিত। কারণ, স্কুলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে একটা মশার দল! স্কুলের বাচ্চারা সবে দ্বিতীয় পিরিয়ডের জন্য ক্লাসে বসেছে। প্রথম শ্রেণির ক্লাসরুমে বসে আছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, কেউ চুপচাপ, কেউ একটু-আধটু বকবক করছে। হঠাৎ করেই ক্লাসের মধ্যে কোথা থেকে যেন মশার ভোঁ ভোঁ শব্দ শোনা গেলো।
"ম্যাম! মশা! মশা!" বলে চিৎকার করে উঠলো ছোট্ট রাফি। ক্লাসের সবারই নজর গেলো সেই মশাটার দিকে। কিন্তু এ তো একটামাত্র মশা নয়; কয়েকটা একসাথে এসেছে। মশারা ক্লাসের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর একেকজনের গায়ে কামড় বসাচ্ছে। মিস লতিফা, প্রথম শ্রেণির শিক্ষিকা, বাচ্চাদের চুপ করানোর চেষ্টা করলেন। "শান্ত হও, বাচ্চারা! একসাথে এত আওয়াজ করো না। দেখি, কী করা যায়।"
তিনি বুঝতে পারছিলেন, মশাগুলোকে ক্লাস থেকে তাড়ানো জরুরি, নইলে বাচ্চারা পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারবে না। তাছাড়া মশা কামড়ালে ডেঙ্গু বা অন্যান্য রোগ হওয়ারও ভয় থাকে। কিন্তু এইসব কথা এত ছোট বাচ্চাদের কীভাবে বোঝাবেন?
স্কুলের বাকি ক্লাসগুলোতেও একই অবস্থা। সব ক্লাসে মশার দল উড়ে বেড়াচ্ছে, আর বাচ্চারা চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। ক্লাসের শিক্ষকরা সবাই বিরক্ত হয়ে পড়েছেন, কারণ এমন পরিবেশে বাচ্চাদের পড়ানো অসম্ভব। স্কুলে একটা জরুরি অবস্থা দেখা দিয়েছে যেন!
বিষয়টা খুব সিরিয়াস হয়ে উঠলো। মশার উপদ্রব শুধু প্রথম শ্রেণির ক্লাসেই নয়, পুরো স্কুলেই ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরই প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর স্যার একটা জরুরি মিটিং ডাকলেন। মিটিংয়ে স্কুলের সব শিক্ষক এবং স্টাফদের ডেকে পাঠানো হলো। মঞ্জুর স্যার চিন্তিত মুখে বললেন, "স্কুলে মশার উপদ্রব এভাবে বাড়তে থাকলে আমাদের খুব বিপদে পড়তে হবে। কিছু একটা করতেই হবে।"
সহকারী শিক্ষক মিনা ম্যাডাম বললেন, "মনে হচ্ছে স্কুলের আশেপাশে কোথাও জমে থাকা পানি থেকে মশা জন্মাচ্ছে। আমাদের আগে এটা খুঁজে বের করতে হবে।"
পিওন কালাম ভাই বললেন, "সত্যিই, এই এলাকায় ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এগুলোর প্রকোপও বেড়েছে। আমাদের স্কুলের বাচ্চাদের সুস্থ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"মঞ্জুর স্যার চিন্তা করে বললেন, "তাহলে আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে। প্রথমত, স্কুলের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাচ্চাদের জন্য মশারি বা মশার প্রতিরোধমূলক স্প্রে ব্যবহার করতে হবে।"পরের দিন সকাল থেকেই স্কুলে একটা হুলুস্থুল পড়ে গেলো। স্কুলের চারপাশে, বিশেষ করে ড্রেন, বাগান, আর গাছের নিচে জমে থাকা পানি খুঁজে বের করা হলো। স্কুলের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সবাই মিলে স্কুলের আশেপাশে থাকা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করলেন। বাগান পরিষ্কার করে সেখানে কীটনাশক ছিটানো হলো। শুধু তাই নয়, শিক্ষকেরাও উদ্যোগ নিলেন বাচ্চাদের সচেতন করার জন্য। তৃতীয় শ্রেণির ক্লাসে ফারহানা ম্যাডাম একটা ছোট্ট বক্তৃতা দিলেন, "বাচ্চারা, তোমরা জানো মশা থেকে কত রকমের রোগ হতে পারে? ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এগুলো খুবই বিপজ্জনক। তাই তোমাদের ঘরের আশেপাশে কখনো পানি জমতে দেবে না, মশারি টানিয়ে ঘুমাবে, আর প্রয়োজনে মশার স্প্রে অথবা কয়েল ব্যবহার করবে।"
বাচ্চারা মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলো। তাদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়তে লাগলো। ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলে আসার সময় এখন থেকে হাতের কনুই, পায়ের টাখনু ঢেকে কাপড় পরা শুরু করলো। অভিভাবকরাও স্কুলের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেন।
সপ্তাহ দুয়েক পর, স্কুলে মশার উৎপাত অনেকটাই কমে গেল। মঞ্জুর স্যার এবং শিক্ষকবৃন্দ খুশি হলেন যে তাদের উদ্যোগ সফল হয়েছে। কিন্তু তারা জানতেন, শুধু একবার পরিষ্কার করলেই হবে না; এই সচেতনতা সবসময় ধরে রাখতে হবে। একদিন প্রার্থনার পরে মঞ্জুর স্যার বাচ্চাদের বললেন, "দেখো, আমরা সবাই মিলে মশাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতেছি। এটা আমাদের একটা শিক্ষনীয় অভিজ্ঞতা। তোমাদের ঘর, স্কুল, আর চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বও কিন্তু তোমাদের। তোমরা যদি ছোট থেকেই এই অভ্যাসটা গড়ে তোলো, তাহলে বড় হয়ে তোমরা দেশকে আরও সুন্দর ও সুস্থ রাখার কাজ করতে পারবে।" বাচ্চারা সবাই হাততালি দিলো। তারা জানে, এবার থেকে তারা শুধু পড়ালেখাই করবে না, বরং নিজেদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষা করতেও সচেতন থাকবে। এই গল্প থেকে আমরা শিখতে পারি, মশা বা অন্যান্য রোগজীবাণুর হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের চারপাশ সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ছোট ছোট সচেতনতামূলক উদ্যোগই বড় সমস্যার সমাধান করতে পারে। সবশেষে, আমরা যদি সবাই মিলে একসাথে কাজ করি, তাহলে কোনো কিছুই আমাদের হারাতে পারবে না।
মন্তব্য করুন