রাজকন্যা ও জাদুর লাঠি
অনেক দিন আগে ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম শায়ার রাজ্যের রাজা ছিলেন চার্লস হেউড। সৎ ,সহজ, সরল ও নিরহংকারী রাজা চার্লস তার প্রজাদের খুব ভালোবাসতেন। প্রজারাও তাকে খুব সম্মান করতো ও ভালোবাসতো। তার রাজ্যটি নটিংহ্যাম শায়ার ও পাশের শেড়উড বন নিয়ে ছিলো তার ছোট রাজত্ব। রাজা চার্লস হেউড খুব ভালো মানুষ হলেও তার সেনাপতি রবার্ট হেনটা খুব জটিল ও লোভী ছিলো। সে সুযোগ বুঝে একদিন সকালে রাজা চার্লস হেউডকে বন্দী করে নিজেকে রাজা ঘোষণা করলো। রাজার একমাত্র রাজকন্যা লিয়া হেউড তার গভর্নেস ক্যাথরিনের সহযোগিতায় রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে একাকী কাঁদতে কাঁদতে শেড়উড বনের ভেতর দিয়ে চললো। পথ চলতে চলতে তার খুব ক্ষুধা পেলো। সে এদিক ওদিক খাবারের সন্ধানে তাকাতে লাগলো আর কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর তার চোখে পড়লো একটা কুঁড়েঘরের দিকে । সে কুঁড়েঘরের দরজায় টোকা দিতেই একটা সাদা চুলওয়ালা বুড়ি দরজা খুলে খনখনে গলায় বলল," ও মেয়ে, তুমি কাঁদছো কেন? কি চাও আমার কাছে?" রাজকন্যা লিয়া বলল," আমি খুব ক্ষুধার্ত বুড়ি মা, আমাকে কিছু খেতে দাও।" বুড়ি বলল," আমিতো এমনি এমনি কাউকে কিছু দেই না বাপু, খাবার পেতে হলে আমাকে অনেকগুলো কাজ করে দিতে হবে। " লিয়া বলল," ঠিক আছে বুড়ি মা, তোমার কাজগুলো দাও,করে দেই। তারপরেই না হয় খাবার দিও।" বুড়ি তখন তাকে থালা বাসন ধোয়া, পানি আনা, ঘর মোছা ইত্যাদি অনেক কাজ ধরিয়ে দিলো। কিন্তু কাজ শেষে বুড়ি তাকে অনেকগুলো সাদা রুটি আর গাজরের হালুয়া দিলো। এতো খাবার দেখে রাজকন্যা লিয়া অনেক খুশি হলো। সে অর্ধেক খাবার তক্ষুনি খেয়ে, বাকি খাবারটা রাতের জন্য নিয়ে বুড়িকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার বনের পথে বেরিয়ে পড়লো। কিছুদূর যাবার পর একটা শেয়াল তাকে দেখে দৌড়ে এলো। শেয়ালটা খুব চালাক আর লোভী ছিলো। সে খক খক করে কেশে জিজ্ঞেস করলো," তুমি রাজকন্যা লিয়া না? তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। একবার ভালুকের হাত থেকে তিনি আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন। তাই তোমাকে আমি খাবো না। কিন্তু তোমার হাতের সাদা রুটি আর গাজরের হালুয়া তো আমাকে দিয়ে যেতে হবে। আমি খুব ক্ষুধার্ত। " এ কথা বলেই শেয়াল তার হাত থেকে খাবারগুলো কেড়ে নিলো। রাজকন্যা লিয়া তখন মনে দুঃখ নিয়ে সামনে এগুতে লাগলো। পথেই তার বুড়ির সাথে আবার দেখা হয়ে গেল। বুড়ি বাজার করে ঘরে ফিরছিলো । সে বুড়িকে সব কথা খুলে বললো। বুড়ি বলল," ঠিক আছে বাছা, আজ রাতটা তুমি আমার সাথেই থাকো। কাল আবার আমার কাজ করে দিয়ে খাবার দাবার নিয়ে তারপর যেও।" রাজকন্যা লিয়া বুড়ির কথায় রাজি হলো। পরের দিন বুড়ির কাজগুলো করে দিতেই বুড়ি তাকে আগের দিনের মতো অনেক গুলো সাদা রুটি আর গাজরের হালুয়া দিলো। সাথে একটা পেল্লাই আকারের লাঠি দিয়ে বলল," বাছা, এই লাঠিটি সাধারণ লাঠি নয়, এটা জাদুর লাঠি। কেউ তোমার খাবার কেড়ে নিতে এলে বা আক্রমণ করতে এলে অথবা কাউকে শাস্তি দিতে হলে তুমি শুধু বলবে ,
"ঐ লাঠি উঠে পড়,
শুরু কর মারধর। "
তাহলেই লাঠি তার খেলা দেখিয়ে দেবে আর তুমি বিপদ থেকে বেঁচে যাবে।"
রাজকন্যা লিয়া বুড়িকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করল। কিছু দূর যেতেই লিয়া দেখলো এক শিকারী তার চারটে কুকুর নিয়ে একটা সিংহকে তাড়া করেছে। কুকুর গুলো সিংহটাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলায় সিংহটি জীবন রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে একটা সিডার গাছে চড়েছে। আর শিকারীটি তাই চাইছিলো । সিংহটা গাছে উঠতেই সে সিংহটাকে একটা তীর ছুঁড়ে মেরে ফেললো। তারপর ধনুকটা নামিয়ে সে মৃত সিংহটার কাছে যেতেই তার চোখ পড়ল রাজকন্যা লিয়া আর ওর খাবারগুলোর উপর। শিকারী লোকটি খুব ক্ষুধার্ত ছিলো । সে দৌড়ে এসে রাজকন্যার হাত থেকে খাবারগুলো কেড়ে নিতে চাইলো, তার কুকুরগুলোও ঘেউ ঘেউ করতে করতে তার পিছু পিছু এলো । রাজকন্যা লিয়া খুব অসহায় বোধ করলো। এমন সময় তার মনে পড়লো বুড়ির দেয়া লাঠিটার কথা।সে চিৎকার করে উঠল,
" ঐ লাঠি উঠে পড়,
শুরু কর মারধর।"
আর সাথে সাথে লাঠিটা শিকারী ও তার কুকুর গুলোকে আচ্ছা মতো পিটাতে লাগলো। মারের চোটে শিকারী আর তার কুকুরগুলো কোনক্রমে দৌড়ে পালালো। তখন শিকারীর ফেলে যাওয়া ধনুক ও তীর গুলো রাজকন্যা লিয়া কুড়িয়ে নিলো। পথে খিদে লাগলে সে এই তীর, ধনুক দিয়ে হরিণ শিকার করে , তারপর আগুনে ঝলসে খেয়ে নিতো। রাজকন্যা লিয়ার উদ্দেশ্য ছিলো শেড়উড বন পেরিয়ে পাশের রাজ্য ইয়র্ক শ্যায়ারে আশ্রয় নেয়া। এরপর যেতে যেতে সে একদিন শেড়উড বন পেরিয়ে ইয়র্ক শ্যায়ারে ঢুকে পড়লো। ইয়র্ক শ্যায়ার রাজ্যটা শুরু হয়েছে ইয়র্ক শ্যায়ার বন দিয়ে। বেশ অনেক দূর যাবার পর রাজকন্যার চোখে পড়লো একটা চকলেটের তৈরি সুন্দর রাজ প্রাসাদ। নানা রঙের,নানা স্বাদের চকলেট দিয়ে তৈরি এই প্রাসাদ থেকে দারুন খুশবু ভেসে আসছে। রাজকন্যা লিয়া তাড়াতাড়ি রাজপ্রাসাদ দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেইতো অবাক। একটা সুন্দর সিংহাসনে একজন খুব সুন্দর রাজপুত্র বসে আছে। কিন্তু তার পেট থেকে পা পর্যন্ত চকলেটের তৈরি। রাজকন্যা লিয়া রাজপুত্রের কাছে জানতে চাইলো তার এই অবস্থা কে করলো? রাজপুত্র বলল," আমি ইয়র্ক শ্যায়ারের রাজপুত্র । নাম জ্যাক ফ্রান্সিস। এক দুষ্ট ভুত আমার পিতা মাতাকে হত্যা করে, জনগনকে বনের পশু পাখি বানিয়ে এই রাজ্য দখল করেছে। সে মায়া বলে আমার শরীরের অর্ধেক আর এই পুরো রাজপ্রাসাদকে চকলেট বানিয়ে ফেলেছে। প্রতি রাতেই সে ফিরে এসে ঐ চাবুকটা দিয়ে মেরে মেরে আমাকে অত্যাচার করে। " রাজকন্যা লিয়া বলল,"বটে! আজ আসুক তবে।" এরপর রাত একটু গভীর হতেই ভুতটি অদ্ভুত সবুজ রঙের আলো ছড়িয়ে রাজপ্রাসাদে এলো। আর যায় কোথায়, রাজকন্যা লিয়া লাঠির দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পড়লো -
"ঐ লাঠি উঠে পড়,
শুরু কর মারধর।"
লাঠি তখন ভুতটাকে বেদম পিটুনি দিলো । মার খেয়ে ভুতটি চেঁচাতে লাগলো আর তাকে ছেড়ে দেবার জন্য রাজকন্যার কাছে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। রাজকন্যা বলল," ছেড়ে দিতে পারি, কিন্তু আমার শর্ত পুরণের পর। । তুই রাজপুত্র জ্যাক ফ্রান্সিসকে সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ করে দে, আর দেশের জনগণকে পশু পাখি থেকে আবার মানুষ বানিয়ে দে।" ভুতটা সাথে সাথে তাই করলো আর রাজ্য ছেড়ে পালালো। রাজপুত্র জ্যাক আর রাজকন্যা লিয়ার ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। ক'দিন পর রাজপুত্র জ্যাক আর রাজকন্যা লিয়া বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে নটিংহ্যাম শায়ার রাজ্য থেকে দুষ্ট রাজা রবার্ট হেনটাকে উৎখাতের জন্য রওনা দিলো। রবার্ট হেনটা দুষ্ট হলেও খুব চালাক ছিলো । রাজকন্যা লিয়ার জাদুর লাঠির কথা সে আগেই শুনেছিলো। বেধরক পিটানি আর কে খেতে চায়? রবার্ট হেনটা তাই রাজ্য ছেড়ে পালালো। তারপর লিয়া আর জ্যাক রাজা চার্লস হেউডকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আবার সিংহাসনে বসিয়ে দিলো । রাজা অনেক দিন তার মেয়ে ও মেয়ে জামাইকে নিজের কাছে রাখলেন। তারপর একদিন শুভক্ষণ দেখে জ্যাক ও লিয়া ইয়র্ক শ্যায়ারে ফিরে এসে সুখে শান্তিতে তাদের রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলো।
মন্তব্য করুন