স্বপ্নার চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প এখন মাসে ২০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন

নিজের আলোয় ডেস্ক ঃ শতরঞ্জি বা ডুরি একসময়ের বিত্তবানদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে আসন, শয্যা, বিছানায় ব্যবহৃত হতো। বিশ্বের বুনন শিল্পের প্রাচীনতম ধারা এই শতরঞ্জি দিয়ে ইদানিং ব্যাগ, পার্স, টেবিল ম্যাটসহ নানা সৃজনশীল পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। আবহমান কাল থেকে চলে আসা রংপুরের শতরঞ্জি গত ২০২১ সালের ১৭ জুন বাংলাদেশের একটি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এটা নিয়ে কাজ করে যাওয়া রংপুর ক্রাফট এর স্বত্বাধিকারী স্বপ্না রানী সেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই ফাউন্ডেশন) উদ্যোক্তা পুরস্কার-পেয়েছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের বনেদী পরিবারে বেড়ে ওঠা স্বপ্না ১৯৯৭ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৯৮ সালে বিয়ের পর স্বামীর চাকরির সুবাদে রংপুরে থাকা শুরু করেন এবং কারমাইকেল কলেজে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। সংসার সামলানোর পাশাপাশি লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে ভোলেননি। সদ্যজাত সন্তান নিয়ে ২০০১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন।
স্নাতকোত্তরের ফল বের হওয়ার কিছুদিন পরই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বপ্না চাকরি শুরু করেন। সেখানে তিনি নির্যাতিত ও অসহায় নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করতেন। তবে বাবা শিক্ষক হওয়ায় তারও শিক্ষক হওয়ার খুব শখ ছিল। প্রাইমারির শিক্ষক হওয়ার জন্য কয়েকবার পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। স্বপ্না বলেন, শিক্ষক হওয়ার খুব শখ ছিলো।
কিন্তু ওভাবে প্রস্তুতি না থাকায় চাকরি হয়নি। পরে সন্তান-সংসার, বিভাগের পড়াশোনা নিয়ে সেভাবে আর প্রস্ততি নেওয়া হয়নি। বিয়ের পর তার স্বামী নয়নমনি সরকার লেখাপড়া, চাকরি থেকে শুরু করে সব বিষয়ে ছায়ার মতো পাশে থেকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। একটা সময়ে এসে তারা চিন্তা করেন, বেসরকারি চাকরিতে নির্ভর করে জীবন পরিচালনা করা ঝুঁকি। এজন্য তারা এমন কিছু করার চিন্তা করেন, যার মাধ্যমে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কিছু মানুষকে কর্মসংস্থান করা যায়। বিশেষ করে নারীদের যাতে কর্মসংস্থান হয়। সে ভাবনা থেকে ২০১১ সালে শতরঞ্জি নিয়ে উদ্যোগ শুরু করেন।
প্রথমে তিনি ১০ জন নারী নিয়ে কাজ শুরু করেন। ওই নারীরা আগে থেকেই হাতের কাজ পারতেন। স্বপ্না রানীও অবশ্য বরাবরই হাতের কাজ পারতেন। মায়ের কাছ থেকে তথা পারিবারিকভাবেই শতরঞ্জি, নকশি কাঁথাসহ নানা ধরনের হাতের কাজ শিখেছিলেন।
২০১১ সালে উদ্যোগ শুরুর পরই চাকরি ছাড়েননি। তিনি বলেন, চাকরির পাশাপাশি এটা শুরু করি। কারণ, তার পুঁজি দরকার ছিল। পীরগঞ্জের ওই ১০ জন নারীদের নিয়ে তৈরি করা পণ্য বিক্রি ও প্রদর্শনীর জন্য রংপুরে একটা দোকান ভাড়া নেন। চাকরির পাশাপাশি উদ্যোগ পরিচালনার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু দিনাজপুর থেকে রংপুরে ট্রান্সফার নিতে না পারায় তিনি চাকরিটা ছেড়ে দেন। বর্তমানে রংপুরেই স্থায়ী হয়েছেন।
এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, রংপুরে দোকান দেওয়ার সময় পণ্যের খুব বেশি পরিচিতি ছিল না। এজন্য তেমন বিক্রিও হতো না। চাকরি করে দোকান ভাড়া এবং দোকান দেখাশোনার জন্য যে ছেলেকে রেখেছিলাম, তার বেতন দিতাম। মূলত পণ্যের পরিচিতির জন্যই এ ভর্তুকিটা দিয়েছি। এতে বেশ লাভ হয়েছে।
তিনি বলেন, রংপুরে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ, শতরঞ্জি রংপুরেই তৈরি হয়। অধিকাংশ মানুষ না করলেও শতরঞ্জি এ জেলার আদি কাজ। ব্যবসায়িকভাবে না করলেও নিজেদের ব্যবহারের জন্য তারা শতরঞ্জি তৈরি করতো। কোথায় কাজ করা যায় না যায়, কিভাবে কি শুরু করা যায়, এসব বিষয়ে আমি ও আমার স্বামী সমীক্ষা করে ২০১৩ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে ব্যবসার কাজ শুরু করি।
আরও পড়ুনরংপুর সিটি এলাকায় শতরঞ্জি পল্লী নামে একটা গ্রাম আছে, যেখানে এ কাজগুলো বেশি হয়। সেখানে স্থানীয় কিছু পুরাতন ব্যবসায়ী আছেন, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না গিয়ে পার্শবর্তী রাধাকৃষ্ণপুর নামে একটা গ্রাম বেছে এ উদ্যোক্তা দম্পতি। সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তা করেন। এসময় ‘উই এসএমএস’ ও ‘প্রাকটিক্যাল অ্যাকশান’ নারীদের প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী পণ্য মার্কেটিং করে দিবে এমন শর্তে চুক্তিবদ্ধ হন।
স্বপ্না রানী বলেন, আমাদের প্রশিক্ষক দরকার ছিল ও প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ যোগান দেওয়ার মতো উপায় খুঁজছিলাম। ওই সময় ‘উই এসএমএস’ ও ‘প্রাকটিক্যাল অ্যাকশান’ সার্বিক বিষয়ে বেশ সহযোগিতা করেছিল। প্রথমে আমরা ২০ জনকে প্রশিক্ষণ দিই, তারপর ২৫ জন এবং ৩০ জনের গ্রুপ করে প্রশিক্ষণ দিলাম। এভাবে তিন মাস মেয়াদী এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বছরে তিন-চারটা গ্রুপ হয়ে যায়।
এ সফল উদ্যোক্তা বলেন বলেন, আমার স্বামী নিজেই তাঁতের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। কারণ তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই সময় সেরিকালচারের ওপর ডিপ্লোমা করেছিলেন। সেখানে লুমের কাজ শিখেছিলেন। এজন্য তাঁত বিষয়ে তার একটা ভালো ধারণা তৈরি হয়।
এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা অনেক দক্ষ কর্মী পান। এসব কর্মীরাই এখন তাদের কারখানায় কর্মরত আছেন। এসব কর্মীদের মাসিক চুক্তিতে বেতন দেওয়া হয় না। প্রোডাকশনের ওপর মজুরি দেওয়া হয়। যে পরিমাণ পণ্য প্রস্তুত করে দিবে তার ওপর পান নির্দিষ্ট মজুরি। এতে দেখা যায়, সবার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা কাজ করে। বর্তমানে স্বপ্নার তিন শতাধিক দক্ষ কর্মী রয়েছে।
তিনি বলেন, এক ব্যাচের ট্রেনিং শেষ হলে ২০১৩ সালে চাকরি ছেড়ে রংপুর চলে আসলাম এবং রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামে একটা জমি ভাড়া নিলাম। সেখানে টিনশেডের চালা দিয়ে আটটি তাঁত স্থাপন করলাম। শতরঞ্জির পাশাপাশি সেখানে কোমর তাঁতের কাজও করা হতো। এছাড়া ববিন করার জন্যও আলাদা মেশিন ছিল। এভাবে এক বছরের মধ্যেই ৪০টি তাঁত স্থাপন করলাম। করোনা মধ্যে বাবার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে ৫০টি তাঁত নিয়ে একটা কারখানা তৈরি করেছি। বর্তমানে তিনটি কারখানায় মোট ১৫০টি তাঁত রয়েছে।
এ উদ্যোক্তা দম্পতি কারখানা প্রতিষ্ঠার পর এসএমই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বিভিন্ন মেলাগুলোতে অংশগ্রহণ শুরু করেন। এতে তাদের পণ্যের মার্কেটিংটা খুব সহজভাবে হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যেই রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্যের পরিচিতি ও চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
তার পণ্যের মধ্যে শতরঞ্জির টেবিলের রানার, প্লেস মেট, বিভিন্ন লেডিস ব্যাগ, মোবাইল ব্যাগ, সাইড ব্যাগ ইত্যাদি রয়েছে। পরবর্তীতে জুট রাগ (পাটের আঁশকে নকশার উপর ভিত্তি করে গিঁট ও বুননের মাধ্যমে এই ‘জুট রাগ’ তৈরি করা হয়) নিয়েও কাজ করেন তিনি। কারণ মানুষের এটার প্রতি চাহিদা রয়েছে এবং তার কারিগররাও এ বিষয়ে বেশ দক্ষ।
তার পণ্যগুলো রংপুর থেকে পাইকারদের মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের প্রতিটি জেলায় চলে যায়। সব মিলিয়ে তিনি প্রতি মাসে ১৫-২০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন। বায়ারদের মাধ্যমে তার পণ্যগুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ব্যবসা হয়ে গেছে খুবই প্রতিযোগিতামূলক। উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছেন স্বপ্না। এসএমই ফাউন্ডেশনের আঞ্চলিক মেলাগুলোতে অংশ নিয়ে পরপর তিনবার প্রথম এবং কয়েকবার দ্বিতীয়ও হয়েছিলেন তিনি।
মন্তব্য করুন