ভিডিও মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট ২০২৫

আজ ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডির ১৯বছর, বাস্তবায়ন হয়নি ৬ দফা

আজ ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডির ১৯বছর, বাস্তবায়ন হয়নি ৬ দফা, ছবি: দৈনিক করতোয়া ।

ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি: ২৬শে আগস্ট, ফুলবাড়ী ট্রাজেডি দিবস। ২০০৬ সালের এই দিনে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি প্রকল্প বাতিল ও বিদেশি কোম্পানি এশিয়া এনার্জির দেশ ত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ ও বিডিআর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি)। এতে বিডিআর-পুলিশের গুলিতে ৩জন শাহাদাতবরণ করেন। দুই শতাধিক নারী-পুরুষ আহতসহ স্থায়ী পঙ্গুত্ববরণ করেন অনেকে।

সেদিন পুলিশ-বিডিআরের সাথে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন অন্তত অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী। আহত হয় প্রায় দুই শতাধিক সাধারণ মানুষ। সেই থেকে প্রতিবছর এই দিনটিকে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর জাতীয় রক্ষা কমিটি এবং সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন ও ফুলবাড়ীবাসী 'ফুলবাড়ী শোক দিবস" হিসেবে পালন করে আসছে। এরপর ততকালিন বিএনপি সরকার ফুলবাড়ীবাসীর সাথে ৬ দফা চুক্তি করে। চুক্তির এক সপ্তাহ পর তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা ফুলবাড়ীতে এক জনসভায় ৬ দফা পূর্ণ বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার করেন। এজন্য আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করতে বলেন। দু বছর পরেই তার দল ক্ষমতায় এসে ১৭ বছর ক্ষমতায় থাকলেও সেই ৬ দফা চুক্তি আজও আলোর মুখ দেখেনি।

ঘটনার পেক্ষাপট: ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট বিকেল ৩টায় তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী তথা দেশ থেকে বহিষ্কারের দাবিতে এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাও কর্মসূচি ছিল। এই লক্ষ্যে ঐ দিন পৌর শহরের ঢাকা মোড়ে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সেখান থেকে ফুলবাড়ী শহরে সাধারণ জনতা বিশাল একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে এশিয়া এনার্জি কোম্পানির অফিসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে, পৌর শহরের ছোট যমুনা ব্রিজের উপর বিডিআর ও পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে তারা বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে সুজাপুর চাঁদপাড়া গ্রামের মৃত মকলেছুর রহমানের ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র তরিকুল ইসলাম (২০), বারকোনা গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে আমিন (১৫) ও উত্তর সাহাবাজপুর গ্রামের সালেকিন (১৭) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এসময় গুলিবিদ্ধ হন অন্তত অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী। এছাড়া দক্ষিণ সাহাবাজপুর গ্রামের প্রদীপ চন্দ্র, রতনপুর গ্রামের শ্রীমান বাস্কে, সুজাপুর গ্রামের বাবলু রায়সহ চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেন। এতে অন্তত দু শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হন। 

ঘটনার পরের দিন ফুলবাড়ীর সর্বস্তরের জনতা প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনকারীরা গাছের গুঁড়ি দিয়ে রেলপথ ও রাজপথ বন্ধ করে দেয়। সারা দেশের সঙ্গে ফুলবাড়ীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অচল হয়ে পড়ে ফুলবাড়ী। শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পরদিন সকালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে হাজার হাজার জনতার মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ফুলবাড়ী শহর। শহরের সমস্ত দোকানপাট, বাজার, ব্যাংক-বীমা, অফিসের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ২৮ আগস্ট সকালে বিডিআর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। 

একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা এশিয়া এনার্জির দালালদের বাড়ি ও অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে তারা এশিয়া এনার্জির ওয়্যার হাউজ, চারটি প্রদর্শনী বিল্ডিং ও ওভার হেড পানির ট্যাংক ভাঙচুর করে। ২৯ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রী খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু ও রাজশাহী সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনু এমপি জাতীয় কমিটির সঙ্গে আলোচনার জন্য দিনাজপুরে আসেন। কিন্তু সেদিনও কোনো আলোচনা হয়নি। 

পরেরদিন ৩০ আগস্ট জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মতে পার্বতীপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে তিন ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ব্যাপক আলোচনা শেষে ছয় দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ছয়দফা চুক্তির মধ্যে ছিল, এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী ও দেশ থেকে বহিষ্কার, উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লাখনি ফুলবাড়ীসহ দেশের কোথাও না করা, পুলিশ-বিডিআরের গুলিতে নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবসা, গুলি বর্ষণসহ হতাহতের প্রকৃত কারণ উদঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন, শহীদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ এশিয়া এনার্জির দালালদের গ্রেফতারসহ শাস্তি প্রদান, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার এবং নতুন করে মামলা না করা। ছয় দফা চুক্তি করার পর আন্দোলনের সমাপ্তি হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ২৬ আগস্ট দিনটিকে ফুলবাড়ী ট্রাজেডি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। 

আরও পড়ুন

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ফুলবাড়ী শাখার আব্বায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল জানান, দিবসটি উপলক্ষে (২৬ আগষ্ট) মঙ্গলবার প্রতিবছরের মত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হবে। কর্মসুচির মধ্যে রয়েছে, কালো ব্যাচ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন,শোক র‌্যালি ও স্মৃতি স্তম্ভে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। 

এদিকে ২০০৬সালের ৪ সেপ্টেম্বর তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা সেসময় স্থানীয় ফুলবাড়ী সরকারী কলেজ মাঠে জনসভায় যোগ দেন। সেখানে তিনি তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে হুশিয়ারী করে ৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বলেন। অন্যথায় ফুলবাড়ীবাসীকে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দেন। এসময় তিনি অঙ্গীকার করেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ৬ দফা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করবে। এজন্য তিনি আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় ভোট চান। তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে ২০০৮ সালে এই এলাকার মানুষ গণহারে ভোট দিলেও দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতায় থাকলেও ৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়নের চেষ্টাও করেননি তিনি।

উল্লেখ্য, জানাগেছে, ফুলবাড়ী, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর উপজেলার কিছু অংশে মাটির মাত্র ৪০০ফিট নিচে প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। ১৯৯৪ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সংস্থা বিএইচপির সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়। পরে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সরকার ৩০ বছর মেয়াদি একটি অসম চুক্তি করে। প্রস্তাবিত ওই চুক্তি অনুযায়ী, উত্তোলিত কয়লার মাত্র ছয় শতাংশ পাবে বাংলাদেশ, ৯৪ শতাংশ পাবে এশিয়া এনার্জি। যার ৮০ শতাংশ এশিয়া এনার্জি রপ্তানি করবে। প্রস্তাবিত কয়লাখনি হলে পুরো ফুলবাড়ী শহরসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পানির স্তর নিচে নেমে গেলে কৃষিতে প্রভাব পড়বে, হুমকির মুখে পড়বে পরিবেশ। এসব বিবেচনায় পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হন এবং গঠন করা হয় ‘ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটি’। শুরু হয় আন্দোলন। সেই আন্দোলনের চুড়ান্ত রুপ হিসেবে ২৬ আগষ্ট এশিয়া এনার্জির অফিস ঘেরাও কর্মসূচীতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। 

 

 

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন শুরু

সেপটিক ট্যাংকে নেমে প্রাণ গেল দুই শ্রমিকের

২৫ অতিরিক্ত বিচারকের শপথ পড়ালেন প্রধান বিচারপতি

ডাকসু নির্বাচন: রিটার্নিং অফিসারের সাথে বেয়াদবি করলে বহিষ্কার

কারাগার হচ্ছে ‘কারেকশন সার্ভিস বাংলাদেশ’

রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে নারীকে কুপিয়ে হত্যা