অনুমোদন চেয়ে বিটিআরসিকে চিঠি
বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চায় স্টারলিংক

আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক চলতি বছরের মে মাসে দেশে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও শুরুতে স্থানীয় গেটওয়ে ছাড়াই বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি বাংলাদেশে গেটওয়ে স্থাপন করার কথা জানিয়েছে স্টারলিংক। গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের পর এখন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ইলন মাস্কের কোম্পানিটি। এজন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন চেয়েছে স্টারলিংক। গত ১৩ আগস্ট বিটিআরসি মহাপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন ডিভিশন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফিউল আজম পারভেজের কাছে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশের গেটওয়ে ব্যবহার করে বিদেশি গ্রাহকদের জন্য ডাটা পরিবহনে অনুমোদন চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
চিঠি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের গেটওয়ে ব্যবহার করে অন্য দেশের গ্রাহকদের সেবা দিতে চায় স্টারলিংক। এজন্য বাংলাদেশে স্থাপিত পপ (পয়েন্ট অব প্রেজেন্স) থেকে সিঙ্গাপুর ও ওমানের পপে আন্তর্জাতিক ব্যাকহল সংযোগের জন্য এই অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। দেশীয় আইটিসি থেকে ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিজড সার্কিট (আইপিএলসি) এবং আনফিল্টারড আইপি কিনে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক সেবা চালু রাখবে, তবে আনফিল্টারড আইপি দিয়ে বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের জন্য নয়, শুধু বিদেশি ব্যবহারকারীদের সেবা দেবে স্টারলিংক।
আইপিএলসি সার্ভিস হলো এমন একটি আন্তর্জাতিক ডাটা পরিবহন ব্যবস্থা, যেখানে এক দেশের নেটওয়ার্ক থেকে ডাটা নিয়ে সরাসরি অন্য দেশের (যেমন সিঙ্গাপুর বা ওমান) পপে পাঠানো হয়। আর আনফিল্টারড আইপি হচ্ছে এমন একটি ফিল্টারবিহীন আইপি ব্লক, যা ব্যবহার করে ডেটা কোনো ফিল্টার, কনটেন্ট ব্লকিং বা লোকাল নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সরাসরি আন্তর্জাতিক লিংকে পাঠানো হয়।
বিটিআরসিতে পাঠানো চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, স্টারলিংকের নেটওয়ার্ক রেজিলিয়েন্সি ও রিডান্ডেন্সি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়।
এজন্য তাদের প্রতিটি আন্তর্জাতিক পপ অন্তত দুই বা ততোধিক পপের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ সংযোগে আনফিল্টারড আইপি ট্রানজিট ব্যবহৃত হলেও তা বাংলাদেশি ব্যবহারকারীর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
চিঠিতে স্টারলিংক জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশে অনুমোদিত কোম্পানি ফাইবার অ্যাট হোম, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি (বিএসসিসিএল) ও সামিট থেকে আইপিএলসি এবং আনফিল্টারড আইপি কিনবে। এই অবকাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশের গেটওয়ে ব্যবহার করে বিদেশি গ্রাহকদের জন্য ডেটা পরিবহন করা হবে। তবে বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের সেবা এর আওতায় পড়বে না। বাংলাদেশের ভেতরের ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট সেবা স্থানীয় ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) হয়ে যাবে এবং আইন অনুযায়ী সব ধরনের নিরাপত্তা, ফিল্টারিং ও কনটেন্ট ব্লকিং মানা হবে। বাংলাদেশের স্টারলিংক পপ থেকে সিঙ্গাপুর ও ওমান পপে যে আন্তর্জাতিক লিংক যাবে, সেটি আনফিল্টারড আইপি ব্যাকহল হবে, যা শুধু বিদেশি ব্যবহারকারীদের জন্য।
চিঠিতে দাবি করা হয়, এর আগে গত ২৯ এপ্রিল এক গোলটেবিল বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা ও অনুমোদিত হয়েছে। এনজিএসও লাইসেন্স প্রদানের পূর্বেই স্টারলিংককে এই অনুমোদনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয় সেই বৈঠকে, যেখানে বিটিআরসি চেয়ারম্যান, ফাইবার ও আইপিএলসি প্রোভাইডারসহ বিটিআরসির সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। পরে গত ২৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এবং বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাতেও অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
তবে গত ৩১ জুলাইয়ের বৈঠকে কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি চিঠির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন চেয়েছে, যাতে তারা অনুমোদিত সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্যিক আইপিএলসি এবং আনফিল্টারড আইপি ব্যবহারের জন্য চুক্তি করতে পারে এবং বিদেশি ব্যবহারকারীদের সেবা দিতে পারে।
তবে বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, স্টারলিংকের দাবি সঠিক নয়। লাইসেন্স প্রদানের আগেই তাদের এই অনুমোদনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। তাদের আবেদনের বিষয়ে আগে আলোচনা হলেও অনুমোদন হয়নি। আইপিএলসি গাইডলাইনে যেভাবে প্রভিশন আছে সেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে বিটিআরসি।
আরও পড়ুনএদিকে, স্টারলিংকের এই প্রস্তাব ঘিরে দেশের প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একদিকে আশাবাদ, অন্যদিকে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্টারলিংকের প্রস্তাব অনুমোদনের বিষয়ে খোদ বিটিআরসিতেও নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। বিটিআরসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের দাবি সঠিক নয়। গাইডলাইনেও বিষয়টি নেই, এমনকি গাইডলাইন অনুযায়ী এটার সুযোগও নেই। কারণ গাইডলাইনে আইপিএলসি শুধু সিগনালিংয়ের জন্য, ট্রাফিকের জন্য নয়। এভাবে অনুমোদন দিলে আমাদের মনিটরিং থাকবে না, আইনগত ইন্টারসেপশনও থাকবে না।
খাত সংশ্লিষ্টদের মত ভিন্ন হলেও সবাই নিরাপত্তা ও নীতিমালার স্বচ্ছতার ওপর জোর দিয়েছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশ করিডোর বা ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হলে অর্থনৈতিক সুবিধা মিলতে পারে, তবে বাইপাস হয়ে তথ্য প্রবাহিত হওয়ার ঝুঁকি জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ প্রস্তাব গ্রহণ করলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে অংশীদার হবে, তবে একই সঙ্গে নিরাপত্তা, নীতিমালা ও বাজার কাঠামোর ভারসাম্য রক্ষা করাই বড় চ্যালেঞ্জ।
ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সুমন আহমেদ সাব্বির বলেন, আনফিল্টারড আইপি মূলত বাংলাদেশের জন্য ব্যবহার হবে না, এটি আন্তর্জাতিক ট্রাফিক পরিবহনের জন্য। বিশ্ব এখন উন্মুক্ত, সেখানে ডেটা ফিল্টার করার সুযোগ নেই, অন্য দেশ ফিল্টারড আইপি নেবে না। এ ছাড়া তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী স্টারলিংক আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আইপি কিনবে, এতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হবে।
ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) অপারেটর বাহনের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা রাশেদ আমিন বিদ্যুৎ বলেন, দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠান লাভবান হলেও আনফিল্টারড আইপি ব্যবহারে কিছু ট্রাফিক সাইবার নিরাপত্তার আওতার বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়, ট্রাফিক মনিটরিং সম্ভব নাও হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিও দুর্বল হতে পারে এবং ভবিষ্যতে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিযোগিতার চাপে পড়তে পারে। তাই আনফিল্টারড আইপি ব্যবহারের অনুমোদন দিলে নজরদারির বাইরে ডেটা ঠেকাতে বিটিআরসিকে বিশেষ টেকনিক্যাল মনিটরিং সেল গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।
স্টারলিংকের প্রস্তাব অনুমোদনের বিষয়ে বিটিআরসির অবস্থান জানতে চাইলে সংস্থাটির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন ডিভিশনের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফিউল আজম পারভেজ বলেন, স্টারলিংকের আবেদনের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আবেদন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তাদের আবেদনের বিষয়ে গাইডলাইনে কোনো বাধা আছে কি না, তারা কী চাচ্ছে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল বিষয়গুলো যাচাই করা হচ্ছে। যাচাই শেষে দেশের স্বার্থ বিবেচনায় গাইডলাইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হবে। গাইডলাইনের বাইরে গিয়ে অনুমোদনের সুযোগ নেই।
গ্রাউন্ড স্টেশস স্থাপন হলেও কার্যকারিতা নিশ্চিত নয় বিটিআরসি: স্টারলিংক সার্ভিসেস বাংলাদেশ লিমিটেড সারা দেশে চারটি স্থানীয় গেটওয়ে স্থাপন সম্পন্ন করেছে। বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের হাইটেক পার্কে দুটি এবং রাজশাহী ও যশোরে একটি করে গেটওয়ে স্থাপন করা হয়েছে। তবে এগুলো পুরোপুরি কার্যকর কি না তা নিশ্চিত হতে পারেনি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি।
এর আগে বিটিআরসি স্টারলিংককে তিন মাসের জন্য ছাড় দেয়, যার মাধ্যমে গেটওয়ে ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করতে পারে। যদিও নির্দেশিকা অনুযায়ী গেটওয়ে স্থাপন বাধ্যতামূলক ছিল। স্টারলিংককে গত ২৯ এপ্রিল অপারেটিং লাইসেন্স দেওয়ার পর ৮ মে পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের অনুমতি দেওয়া হয়, যার মেয়াদ ৭ আগস্ট শেষ হয়।
লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী, সেবা শুরু করার আগে কোম্পানিকে অন্তত একটি গেটওয়ে সিস্টেম বাংলাদেশে স্থাপন করার কথা। বিটিআরসির নথি অনুসারে, ১০ আগস্ট স্টারলিংক ইমেইলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে চারটি গেটওয়ে স্থাপন করার কথা জানায়, তবে কমিশনে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়নি। এরপর গত ১৩ ও ১৬ আগস্ট স্টারলিংকের অবকাঠামো যাচাইয়ের জন্য পরিদর্শনে যায় বিটিআরসির প্রতিনিধিদল। পরিদর্শনের সময় স্টারলিংকের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় গেটওয়েগুলো পুরোপুরি কার্যকর কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেনি বিটিআরসি। তবে স্থানীয় অংশীজনদের তথ্য মতে, স্টারলিংক তাদের কমার্শিয়াল ট্রাফিক আদান-প্রদান করছে। স্টারলিংক বাংলাদেশে স্থাপিত গেটওয়ে কিংবা অন্য দেশের গেটওয়ে ব্যবহার করে তাদের ট্রাফিক সঞ্চালন করছে কি না তাও স্পষ্ট নয়, আইন মেনে তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়টিও নিশ্চিত হতে পারেনি বিটিআরসি।
মন্তব্য করুন