মুজিব মানেই স্বাধীনতা
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ মহকুমার টুংগীপাড়া গ্রামে বাবা শেখ লুৎফুর রহমান ও মাতা শেখ সায়রা খাতুনের কোল আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিলেন ছোট্ট শিশু 'খোকা'। যার শৈশব-কৈশোর কাটে পিতা-মাতার আদর -স্নেহও ভালোবাসায় টুঙ্গিপাড়ায় মধুমতি নদীর তীরে।
গোপালগঞ্জে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করে, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ধীরে ধীরে রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। ছোট্ট শিশু 'খোকা' থেকে শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা ইসলামিক কলেজের ১৯৪৫-৪৬ শিক্ষা বর্ষে বেকার গভমেন্ট হোস্টেলের ২৪ নাম্বার কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আপামর জনগণের শ্রদ্ধা নিদর্শন স্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগ এই ২৪ নাম্বার কক্ষটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ হিসেবে সংরক্ষিত।
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতির পদার্পণের মধ্য দিয়ে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মত এক প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতার সান্নিধ্য পায়। যা বঙ্গবন্ধুকে দেশভাগের আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির জাতিসত্তা গঠনের আন্দোলনে মূল প্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র শুরু থেকেই বাঙালির ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতে থাকে।
শুরু হয় বাঙালিদের উপর শোষণ ও নিপীড়ন।তারই ধারাবাহিকতায় উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করলে সর্বপ্রথম শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ করেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তখন থেকেই প্রতিবাদী হয়ে উঠেন শেখ মুজিব।
নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ পেরিয়ে শেখ মুজিব বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুুত করেছিলেন।
তিনি প্রথমেই ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ৪ঠা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালে জানুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানালে অযৌক্তিকভাবে তাঁকে জরিমানা এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে গ্রেফতার হন।
এ সময় ২৩শে জুন পূর্ব পাকিস্তান 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠিত হয়। জেলে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ১৯৫৩ সালে তিনি দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেন।
তাঁর সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতির ওপর দমন-নিপীড়ন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন।
তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন "এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।" বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দাবির প্রশ্নে কোন আপোষ নেই। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমরা দাবি আদায় করবোই।
আরও পড়ুনজনগণের অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলতে থাকবে। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং মধ্যরাতেই তাঁকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের কারাগারে।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১০ই এপ্রিল তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দীর্ঘ ২৪ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাঙালি জাতির কাক্সিক্ষত বিজয় ও স্বাধীনতা। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করেছেন।
দুবার ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছেন এবং বহুবার কারাবরণ করতে হয়। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা দাবিতে বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ সোচ্চার হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জোরালো হয়।
পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে পদার্পণ করেন। বঙ্গবন্ধু অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি শুরু করেন। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় চলে আসে।
স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ শুরু করে। কিন্তু মানুষের সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হতে দেয়নি ঘাতকেরা। জাতির পিতা সদ্য স্বাধীন দেশকে যখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি দেশি-বিদেশি চক্রান্তে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চবিলাসী বিশ্বাসঘাতকের বুলেটের আঘাতে তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ মেনে সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়াই হবে মূল কাজ। তাহলে স্বাধীনতার এই মর্মার্থ অর্থবহ হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন ১৯৭২ সালের ২৬ শে মার্চে বলেন, আমাদের স্বাধীনতা যদি দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্থ শিশুর মুখে অন্ন তুলে দিতে না পারে, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা, তাহলে স্বাধীনতা মিথ্যা, সে আত্মত্যাগ বৃথা।
আজ বঙ্গবন্ধু কন্যার সুদৃঢ় ও সাহসী নেতৃত্বে স্বাধীনতা আজ দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই দেশ এগিয়ে চলছে। সকল ক্ষেত্রে দেশের এই অগ্রযাত্রার মূল ভিত্তি যে স্বাধীনতা তা আমাদের অনুধাবন করে সকল বাধা-বিপত্তিকে মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়াই হবে তাঁর অনুকরণীয় আদর্শ।
লেখক : দপ্তর সম্পাদক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বগুড়া জেলা শাখা
সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা
শাখা।
01711-451738
মন্তব্য করুন