‘গণত্রাণ’ সৃষ্টি করেছে মহাঐক্য
ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাঁধ খুলে দেওয়া এই বন্যার প্রধান কারণ। এবারের বন্যায় ১২ জেলায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোক সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৮টি। বন্যায় গত শনিবার পর্যন্ত ১২ জেলায় মোট ১৮ জন মারা গেছে।
এর মধ্যে কুমিল্লায় চারজন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামে পাঁচজন, নোয়াখালীতে তিনজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছে। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে তিন হাজার ৫২৭টি। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৮ জন আশ্রয় নিয়েছে। শনিবার সচিবালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান এসব তথ্য জানান।
বন্যাকবলিত এলাকায় নগদ তিন কোটি ৫২ লাখ টাকা, শিশু খাদ্য বাবদ ৩৫ লাখ ও গোখাদ্য বাবদ ৩৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া ত্রাণ কাজের অংশ হিসেবে ২০ হাজার ১৫০ টন চাল ও ১৫ হাজার ব্যাগ শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে চিকিৎসাসেবা দিতে ৭০টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
ফেনীতে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। সেনাবহিনী, জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসকরা সেখানে সেবা দিচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকরা বন্যা দুর্গত এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলা কর্মকান্ডে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য বিশেষ ফোন নাম্বার চালু হয়েছে। ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর জেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোষ্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ছাত্র সমাজ ও বিজিবি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে বলেও জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব।
আকস্মিক বন্যার শুরু থেকেই দুর্গম এলাকা থেকে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা, ত্রাণ বিতরণসহ নানা ধরনের মানবিক কাজ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাসহ সর্বস্তরের মানুষজন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৪ আগষ্ট তৃতীয় দিনের মতো ‘গণত্রাণ’ সংগ্রহ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয় টিএসসি চত্বরে দিনমজুর-রিকশাচালক থেকে শুরু করে নানা বয়স, শ্রেণি-পেশার সর্বস্তরের মানুষ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ে ছুটে আসছেন। সবার হাতে চাল, ডাল, আলু, তেল, খাবার স্যালাইন, লবণ, বিশুদ্ধ পানি, খেজুর, চিড়া, মুড়ি, বিস্কুটসহ নানা ধরনের শুকনো খাবার।
আরও পড়ুনরয়েছে নগদ টাকা, কাপড়-চোপড়, লাইফ জ্যাকেট, শিশু খাদ্য, পশু পাখির খাদ্য, ওষুধ, স্যানিটারি প্যাডসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই। বিভিন্ন দুর্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেকবার ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এবারের মতো বড় আয়োজন এর আগে কখনো দেখা যায়নি। সবার স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে দিনভর টিএসসিতে চলছে মানুষের ঢল।
দিনভর ও রাতের একটি অংশ ত্রাণ সংগ্রহ চললেও এসব ত্রাণ প্যাকেজিং করতে সারারাত টিমভিত্তিক শ্রম দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা এবং ত্রাণসংগ্রহ করতেও রীতিমতো খেতে হচ্ছে হিমশিম। এ ছাড়া টিএসসি এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ ত্রাণ বহন ও প্যাকেজিং করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীরাই।
জানা গেছে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নগদ অর্থ ও ত্রাণ সংগ্রহের পর সারারাত প্যাকেজিং করে প্রতিদিন ভোরবেলায় ট্রাক ভর্তি করে সেগুলো বন্যা দুর্গত এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। গত শুক্রবার ভোররাত পর্যন্ত মোট ২৫ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বন্যা শুরুর পর গত বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে গণত্রাণ সংগ্রহের ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। বৃহস্পতিবার থেকে সংগ্রহ শুরু হয়।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চলমান ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘ত্রাণসংগ্রহ কর্মসূচিতে চারদিনে অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে মোট ৫ কোটি ২৩ লাখ ৩ হাজার ৬০৩ টাকা ৬৮ পয়সা সংগ্রহ করা হয়েছে।
ভয়াবহ বন্যায় জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দিন কাটাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। তবে আশার কথা এই যে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর তরুণদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে জেগে উঠেছে মানবতা। মানুষ দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে।
আগে দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আমরা ত্রাণের জন্য দুর্গত মানুষকে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে দেখেছি। এবার আমরা এর উল্টো চিত্রের সাক্ষী হলাম। আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলে এমনটিই হয়। মহান জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। যে কোনো মূল্যে এ ঐক্য অটুট রাখাও জরুরি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
মন্তব্য করুন