বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে
বজ্রপাতে বিশ্বে প্রতি বছর যত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তার প্রায় অর্ধেক ঘটছে বাংলাদেশে পত্র-পত্রিকায় এমন তথ্য আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টিপাত এবং বজ্রপাতে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু আমাদের দেশে বিরল নয়। উষ্ণ বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা নতুন মেঘ যখন বঙ্গীয় ব-দ্বীপে এসে হিমালয়ের হিমেল বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষণের শিকার হয়, তখন প্রাকৃতিক কারণেই বজ্রপাত হতে পারে। আষাঢ়-শ্রাবণের ঘনঘোর বর্ষায় ক্রমেই প্রশমিত হয় বাতাস ও মেঘের বৈপরত্য। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বজ্রপাতের হার আষাঢ় মাসেও হয়ে থাকে।
চলতি বছরের ৭ মাসে শুধু কৃষি কাজের সময় বজ্রপাতে দেশে ১৫৭ জন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে তবে সংবাদপত্র ও অন্যান্য সূত্রে কৃষকের মৃত্যুর সংখ্যা ২৫০ জনের বেশি। মানুষ হতাহতের ঘটনাও আশংকাজনক হারে বাড়ছে। বজ্রপাতের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক রয়েছে। এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশংকা ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বজ্রপাতে মৃত্যুর চেয়ে তিনগুণ বেশি মানুষ আহত হন। এই আহতরা যখন মারা যান তখন আর হিসাবে ধরা হয় না।
এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, গত ১২ বছরে বজ্রপাতে দেশে মোট ২ হাজার ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এটা সত্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাত বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। একই সঙ্গে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই এমন অস্বাভাবিক বজ্রপাত হচ্ছে মর্মে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বাতাসের মাধ্যমে ঘনকালো মেঘ এবং মাটিতে থাকা নেগেটিভ ও পজেটিভ চার্জে পরিবাহী হওয়া, বনাঞ্চল উজাড় করা, জলবায়ুর পরিবর্তন, জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, অত্যাধিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার ও গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধিকে বজ্রপাতের সবচেয়ে বড় উপায় হলো সচেতনতা।
যখনই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে মেঘের গর্জন হবে, তখন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে। আমাদের দেশে মানুষ বজ্রপাতের সময় মাঠে কাজে যায়, নদীতে মাছ ধরতে যায়, গরু-আনতে মাঠে যায় আবার বাচ্চারা খেলতেও যায়। এটা মোটেও করা যাবেনা। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে বজ্রপাত রোধে নেওয়া হয় বিশেষ পরিকল্পনা ও সতর্কীকরণ কর্মসূচি। কিন্তু মৃত্যুর মিছিল তাতে থামানো যায়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে এক সময় দেশের বেশির ভাগ গ্রাম এলাকায় বড় বড় গাছ থাকত। তাল, নারিকেল, বটসহ নানা ধরনের বড় গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নিত। ফলে মানুষের আঘাত পাওয়ার আশংকা কম ছিল। দেশে বড় গাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। মুঠো ফোনের ব্যবহারও বজ্রপাত বৃদ্ধির জন্য দায়ী বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয়।
আরও পড়ুনআমরা গভীর হতাশার সঙ্গে দেখেছি বিগত দিনে বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দিতে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয় করে কেনা লাইটেনিং সেন্সর কোনো কাজে আসেনি। নিছক ‘কারিগরি জনবল’ না থাকার কারণে জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রযুক্তির এমন পরিণতি কাম্য হতে পারে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে দেখছি আমরা। যে সংখ্যা সংবাদ মাধ্যমের আলোয় এসেছে, তাতেই বাংলাদেশ বজ্রপাতে মৃত্যুর ‘ডেড জোন’ হিসেবে আখ্যা পাওয়া অত্যুক্তি হতে পারে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে হঠাৎ আকাশ থেকে ধেয়ে আসা প্রাকৃতিক ঘাতকের প্রাণ কেড়ে নেওয়া কতটা প্রাকৃতিক ? হঠাৎ বাংলাদেশে বজ্রপাতের হার বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমরা একমত যে, একদিকে বড় বড় গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া’ অন্যদিকে মোবাইল ফোনসহ যান্ত্রিক ব্যবহার বৃদ্ধি মানুষকে বজ্রপাতের নিশানা করে তুলেছে। গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেলিং বিশ্লেষণ করেও একই ধারণা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বজ্রপাত গবেষক।
বস্তুত এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, বায়ু মন্ডলে ধাতব উপাদান বেড়ে গেলে তা বজ্রপাতের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আমরা দেখছি, গত কয়েক বছর ধরে বায়ু দূষণ সম্পর্কিত সূচকগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে থাকছে। বজ্রপাতে রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আনা যেতে পারে।
মন্তব্য করুন