হত্যাসহ ২০ মামলার আসামি
বগুড়ায় ‘সিনেমা স্টাইলে’ আলহাজ শেখ গ্রেপ্তার
স্টাফ রিপোর্টার : বগুড়ার এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসি ৯টি হত্যাসহ ২০ মামলার আসামি জেলা যুবলীগ নেতা, পৌরসভার ৯নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র (২) আলহাজ শেখকে (৫৫)কে ‘সিনেমা স্টাইলে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে ডিবি ও সদর থানার পুলিশের একটি যৌথ টিম শহরের সূত্রাপুর গোহাইল রোড়ে তার প্রতিবেশির বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। প্রতিবেশির ৯ তলা বাড়ির একটি কক্ষ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কক্ষটি তালাবদ্ধ ছিল। পরে তালা খুলে ওই কক্ষ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানে লুকিয়ে ছিলো সে।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া ও ট্রাফিক) সুমন রঞ্জন সরকার জানান, বগুড়া জেলার পুলিশ সুপার মোঃ জেদান আল মুসা, পিপিএম এর সার্বিক দিক নির্দেশনায় ডিবি বগুড়া ও সদর থানা পুলিশের যৌথ টিমের বিশেষ অভিযানে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন পুলিশের তালিকাভুক্ত ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আসামি আলহাজ শেখ।
যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন আলহাজ : অভিযানে অংশ নেয়া মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা ডিবির এসআই জাহাঙ্গীর কবির জানান, গতকাল মঙ্গলবার আলহাজ শেখ তার বাড়িতেই আছেন-এমন খবর পেয়ে ডিবি সদস্যরা সন্ধ্যা থেকেই ছদ্মবেশে তার বাড়ির আশেপাশে নজরদারি শুরু করেন।
অভিযানের দিক নির্দেশনা দেন পুলিশ সুপার নিজে। এরপর প্রযুক্তির সহযোগিতা ও গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তার নিজ বাড়িতেই তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে পুলিশ সুপারের নির্দেশে রাত ১১টার দিকে জেলা ডিবি, সদর থানা ও সদর ফাঁড়ির পুলিশের একটি যৌথ টিম সুত্রাপুর গোহাইল রোডে তার ৯ তলা বাড়িতে অভিযান চালায়।
কিন্তু তার বাড়িতে দীর্ঘ সময় অভিযান চালিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। বাড়ির প্রতিটি কক্ষে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয় তাকে। কিন্তু তার কোন সন্ধান না পেলে হতাশ হয়ে পড়েন ডিবি ও সদর থানার পুলিশ সদস্যরা। এরপর অভিযানের কৌশল পাল্টিয়ে আলহাজের বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়।
এতে দেখা যায় রাত ১১ টা পর্যন্ত আলহাজ শেখ নিজ বাড়ির ছাদে অবস্থান করছিলেন এবং তার বাড়ি উত্তর পাশ সংলগ্ন কাঁচ ব্যবসায়ী বাবুর অপর ৯ তলা বাড়ির ছাদে লাফ দিয়ে পার হচ্ছেন। ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, আলহাজ শেখের ৯ তলা বাড়ি আর ব্যবসায়ী বাবুর বাড়িও ৯ তলা। তাদের বাড়ির ছাদ থেকে ওই ছাদ পাশাপাশি লাগানো।
ছাদ থেকে ছাদের দূরত্ব মাত্র দেড় ফুটের মত। অভিযান আঁচ করতে পেরে আলহাজ শেখ দ্রুত নিজ বাড়ির ছাদে উঠেন এবং প্রতিবেশি বাবুর বাড়ির ছাদে লাফ দিয়ে পার হয়ে যান। এরপর ওই বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে পড়েন। এরপর পুলিশের যৌথ টিম পাশের ওই বাড়িতে নিচতলা থেকে ৯ তলা পর্যন্ত চিরনী অভিযান শুরু করে।
আরও পড়ুনএক পর্যায়ে ব্যবসায়ী বাবুর ৯ তলা বাড়ির ৭ম তলায় অভিযানকালে একটি কক্ষ তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। এরপর রাত ৩ টায় চাবি সংগ্রহ করে ওই কক্ষের দরজা খুলে তল্লাশি করে আলহাজ শেখকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তিনি লুঙ্গি পড়ে লুকিয়ে ছিলেন। ওই বাড়িতে অন্য কেউ ছিলেন না। ৩ ঘণ্টা ব্যাপী এই অভিযান চলে।
কে এই আলহাজ : ধৃত আলহাজ শেখ সুত্রাপুর গোহাইল রোড়ের মৃত মুনসুর শেখের ছেলে। এ ছাড়াও তিনি বগুড়া জেলা যুবলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি, বগুড়া পৌরসভার ৯নং ওয়াডের সাবেক কাউন্সিলর ও সাবেক প্যানেল মেয়র।
সদর থানার ওসি এসএম মঈনুদ্দীন জানান, আগের ৬টি হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্রসহ ১৩টি মামলা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের পর আরও ৩টি হত্যা, অস্ত্রসহ সাতটি মামলা করা হয়েছে। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে মোট মামলার সংখ্যা ২০টি।
এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসি আলহাজ ছিলেন ভয়ংকর। নিজের ভাতিজা খুশবুকে হত্যা করে আলোচনায় চলে আসেন আলহাজ। দেড় দশক আগে শহরের সুত্রাপুরে গোহাইল রোড়ে তার সৎ ভাইয়ের কিশোর ছেলে খুশবুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে প্রায় ১১ লাখ টাকা ভর্তি একটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যান। এরপর আশ্রয় নেন শাজাহানপুর উপজেলার দেশমা গ্রামে। সেখানে গড়ে তোলেন আলহাজ বাহিনী।
চাঁদাবাজি, মারপিট, ভূমি দখলসহ এমন কোন অপরাধ ছিল না যা তিনি করেননি। দক্ষিণ বগুড়ার ত্রাস হিসাবে পরিচিতি পান তিনি। তবে পৌর কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তা অপরাধের ধরণ পাল্টে যায়। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর সরাসরি তিনি কোন অপরাধ করেননি। তবে তিনি আড়ালে থেকে তার সহযোগীদের দিয়ে মানুষের জমি দখল ও চাঁদাবাজি চালিয়ে যেতেন বলে অভিযোগ ওঠে।
এদিকে, আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানিয়েছেন, দেশব্যাপী বৈষম্য বিরোধী কোঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত ৪ আগস্ট শহরের নবাববাড়ী ডায়াবেটিস হাসপাতালের সামনে স্বৈরাচার পতনের দাবিতে ছাত্র জনতার মিছিলে ককটেল বিস্ফোরণ ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপসহ গুলি করা হয়। কমর উদ্দিন বাঙ্গী (৪০) হত্যা মামলারও আসামি আলহাজ্ব শেখ।
আজ বুধবার (৮ জানুয়ারি) তাকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। শুনানি শেষে আদালত ২ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দ শাখার (ডিবি) এসআই মোঃ জাহাঙ্গীর কবির গ্রেপ্তারকৃত আসামি আলহাজ শেখকে আজ বুধবার (৮ জানুয়ারি) বুধবার বগুড়া অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টে আদালতে সোপর্দ করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।
অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুকান্ত সাহা আবেদন শুনানি শেষে ওই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মন্তব্য করুন