তিস্তার পানি বণ্টন

এক কালের প্রমত্তা পদ্মা আর নেই। শীতকালে শুকিয়ে যায়। গরুর গাড়ি এপার-ওপার করে। মানুষও হেঁটে পারাপার হয়। ভারতের ফারাক্কা বাঁধা প্রমত্তা পদ্মাকে খেয়ে ফেলেছে। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রের অনেক কিছুই আজ কেবল স্মৃতি। বড় বড় স্টিমার চলাচল করত নদী দুটিতে। নদী কেন্দ্রিক বাণিজ্যের কারণে উত্তরবঙ্গের অনেক বন্দর ছিল জমজমাট।
এখন বছরের বেশির ভাগ সময় নদী দুটি শুকিয়ে থাকে। নৌকা ও চলতে পারে না। ভারতের গজলডোবা বাঁধ নদী দুটির এ অপমৃত্যুর কারণ। নদীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মরছে নদী কেন্দ্রিক বাংলাদেশও। উত্তরবঙ্গে শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। শস্য উৎপাদনে পড়ছে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। শুষ্ক মৌসুমে গভীর নলকূপেও ঠিকমতো পানি ওঠেনা। ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসা বাংলাদেশের অর্ধ শতাধিক নদীরই আজ এমন দুরাবস্থা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অভিন্ন নদী ৫৪টি। কিন্তু এর মধ্যে পানি বন্টন নিয়ে চুক্তি আছে শুধু গঙ্গা নিয়ে। তবে চুক্তি হলেও গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিসাব বাংলাদেশ পায়না বলে প্রতি বছরই অভিযোগ ওঠে। আর তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি ঝুলে আছে গত পাঁচ দশক ধরে। ফলে শুকনো মৌসুমে তিস্তা মৃত প্রায় রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
জানা যায়, আন্ত:নদী সংযোগের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি ভারতের মধ্যাঞ্চল ও দাক্ষিণাত্যে নিয়ে যাওয়া হবে। এদিকে বিভিন্ন অভিন্ন নদীতে ভারতের বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের কথাও শোনা যায়। সার্বিকভাবে বলা যায়, ভারত যদি অভিন্ন নদীগুলো এভাবে এক তরফাভাবে ব্যবহার করে তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে বাধ্য। ফলে জনজীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।
আরও পড়ুনঅভিন্ন এই নদী তিস্তার ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশের অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়না। ফলে প্রতিবেশি দেশের কারণে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে, কীভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয় সেই প্রশ্ন এসে যায়। বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে এক তরফা পানি উত্তোলনের ফলে এ সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। অন্যদিকে, এই সংকট সমাধান না হওয়ার পেছনে ভারতের এক তরফা মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। সম্প্রতি রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নও ন্যায্য পানির হিস্যার দাবিতে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের কর্মসূচি সামনে এসেছে। এ ছাড়া, ভারত যদি তিস্তার ন্যায হিস্যা না দেয় তাহলে বিকল্প চিন্তা করার কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা।
সংশ্লিষ্টদের এটা অনুধাবন করা দরকার, তিস্তা শুধু একটি নদী নয়, এটি উত্তরবঙ্গের লাখো মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন। তাই, এই ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই্। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে বিএনপি অতি সম্প্রতি রংপুরে তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে সমাবেশ করেছে। তারা তিস্তার ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। এই কর্মসূচির কারণে হয়তো তিস্তা সংকটের সমাধান হয়ে যাবে না।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল হিসেবে কিংবা নাগরিক হিসেবে কিংবা তাদের যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা তুলে ধরেছে, তারও মুল্য কম নয়, যে সময় এবং যে প্রয়োজনে দাঁড়িয়েছে, তাতে আজ সারা বাংলাদেশকেই এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। তিস্তার পানির অধিকার আদায়ে অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে। অভিন্ন নদীগুলোর পানি সমস্যা, বিশেষ করে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে ভারত আমাদের সুনির্দিষ্ট আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও তার রক্ষা করেনি। একের পর এক নানা অজুহাতে তারা কেবল সময়ক্ষেপণ করছে। তাই দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলকেও এর সঙ্গে সংযুক্ত করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।
মন্তব্য করুন