বাঁশের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা কমে যাওয়ায় জয়পুরহাটে কারিগরদের দুর্দিন

জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধি : জয়পুরহাট শহর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে জয়পুহাট-ধামুইরহাট সড়কে খঞ্জপুর এলাকায় মাহালী সম্পদায় দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে বাঁশ শিল্পের কাজ করে আসছে। আগে বাঁশ শিল্পের ব্যাপক চাহিদা থাকায় তাদের ব্যবসা ছিলো রমরমা। কালের বিবর্তনে জয়পুরহাটে বাঁশ সামগ্রীর চাহিদা কমে যাওয়ায় এই শিল্প প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
চাহিদার কারণে পরিবারের নানা কাজের পাশাপাশি গৃহস্থালি কাজেও বাঁশের তৈরি সামগ্রীর ব্যবহার ছিল প্রতিটি ঘরে ঘরে। তবে শহরের চেয়ে গ্রামের গৃহস্থালি ও সংসারের নানা প্রয়োজনে কদর ছিল বাঁশের তৈরি নানা সামগ্রীর। বিশেষ করে ফসল মাড়াইয়ে বাঁশের তৈরি কুলা, চাঙারি, ডালি, ঝাঁটা, মাথালের ব্যবহার ছিল খুবই বেশি। এছাড়া গরুর গোমাই (মুখোশ), হাঁস-মুরগির খাঁচা, ঝুড়ি, খইচালা, মাছ ধরার খলশানী, মাছ রাখার খলইসহ সাংসারিক নানা কাজে বাঁশের তৈরি সামগ্রীর কদরও ছিল। তখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জয়পুরহাটের মাহালি পল্লীতে তৈরি হতো বাঁশের এসব সামগ্রী। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজ করতেন। স্থানীয় হাট-বাজার ছাড়াও ফেরি করে বাড়ি বাড়ি বিক্রি হতো এসব সামগ্রী। দোকানে দোকানেও এসব বিক্রি হতো। খুচরার পাশাপাশি বিক্রি হতো পাইকারিও। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে প্লাস্টিকের সহজলভ্য রকমারি সামগ্রী ও আধুনিক প্রযুক্তির নানা যন্ত্র সেই স্থান দখলে নেওয়ায় ব্যবহার কমেছে বাঁশের তৈরি সামগ্রীর। আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারলেও পূর্ব পুরুষদের এ পেশা ছাড়তে পারছেন না জয়পুরহাটের মাহালি সম্প্রদায়। প্রতিদিন তাদের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ পরিবারের পুরুষ ও নারী সদস্যরা সকাল-বিকেল বাঁশ থেকে তৈরি করছেন নানা সামগ্রী। সকালে বাঁশ কেটে ফালি করে কাঠি তুলে শুকিয়ে বিকেলে পৃথকভাবে যে যার মত করে তৈরি করেন গৃহস্থালি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী। বাঁশের দাম বেশি হলেও চাহিদা কমে যাওয়ায় তৈরি করা সামগ্রীর দাম বাড়েনি। আগে প্রতিটি বাঁশের দাম ছিল ১২০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২২০ টাকা। গ্রাম থেকে বাঁশ সংগ্রহ করতে তাদের দিন চলে যায়। ফলে এ কাজ করে এখন আর তাদের পারিশ্রমিক ওঠে না। এতে দিনে দুই থেকে আড়াইশ’ টাকার বেশি কাজ হয় না। পুঁজি কম থাকায় খুব বেশি লাভ হয় না। অর্থাভাবে অনেকেই বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে এ ব্যবসা ধরে রেখেছেন। লাভ বেশি না হওয়ায় মাহালী সম্প্রদায়ের বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা এ পেশায় আগ্রহ হারাচ্ছেন। লাভের আশায় তারা অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ পেশা থেকেও লাভ করা সম্ভব এমন দাবি কারিগরদের।
মাহালী সম্প্রদায়ের মোহন বাসকে বলেন, একটা বাঁশ গ্রাম থেকে সংগ্রহ করতে তাদের একবেলা চলে যায়। বাঁশের দাম এখন বেশি। আগে ১২০ টাকা হলেও এখন সেই বাঁশ কিনতে হয় ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। একটা বাঁশ থেকে ২-৩টা বাঁশের ডালা-চাঙারি তৈরি করতে ছেলে-মেয়ে উভয়কে সারাদিন পরিশ্রম করতে হয়, যা বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায়। এ দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তারপরও বাপ-দাদার পেশা ধরে আছি আমরা।
আরও পড়ুনওই সম্প্রদায়ের পঞ্চাশোর্ধ নারী কৃষ্ণ মুর্মু বলেন, লাভ না হওয়ায় আমাদের ছেলে-মেয়েরা এ কাজ করতে চায় না। তারা অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। কিন্তু আমরাতো অন্য কাজ করতে পারি না। তাই বাঁশের জিনিসপত্র তৈরি করেই আমরা জীবন পার করছি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) জয়পুরহাটের উপ-ব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ বলেন, বাঁশের তৈরি সৌখিন সামগ্রীর কদর এখনও আছে। এবারের বৈশাখী মেলায় ব্যাপক চাহিদা ছিল এসব সামগ্রীর। আমরা সরকারিভাবে প্রশিক্ষণও দিচ্ছি। এছাড়া কুটির শিল্পর প্রসারে সহজ শর্তে ঋণও প্রদান করা হয়। আবেদন করলে সরকার গৃহিত সকল সুবিধা তাদের দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন