পঞ্চগড়ের মরিচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক খরচ বাড়লেও বাজারে দাম কম

পঞ্চগড় জেলা প্রতিনিধি : বাড়ির পাশের খোলা জায়গা অথবা কোন খেলার মাঠ, প্রখর রোদে চোখে পড়ে শুধুই লাল গালিচা। মনে হবে কোন ভিআইপি আসবে বলে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে লাল গালিচা। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। পঞ্চগড়ের লাল সোনা বলে খ্যাত পাকা মরিচ ছোট-বড় পলিথিনে করে রোদে শুকাতে দিয়েছেন কৃষক-কৃষানিরা।
দূর থেকে দেখলে মরিচ শুকানোর এই দৃশ্যকে দেখা যায় লাল গালিচার মতই। কিন্তু এই লাল সোনা নিয়ে এবার ভাল নেই পঞ্চগড়ের কৃষক। আগের বছরের চেয়ে এবার উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সে হিসেবে ফলন আসছে অনেক কম। শুধু তাই নয়; আগের বছরের চেয়ে এবার অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে এই লাল সোনাকে। সেই সাথে রয়েছে বিরূপ আবহাওয়া। ক্ষেত থেকে পাকা মরিচ বাড়িতে এনে রোদের অভাবে শুকাতেও পারছে না তারা। এ নিয়ে এবার মহাবিপাকে পড়েছে কৃষক।
পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারীসহ অন্য উপজেলাতে শীতের শেষে আবাদ করা হয় মরিচ। এরই মধ্যে মাঠজুড়ে এখন শুধু মরিচ আর মরিচ। মরিচের ক্ষেতে সবুজ পাতার ফাঁকে ঁফঁকে ঝুলে আছে টকটকে লাল মরিচ। সেগুলো হাত দিয়ে তুলে এনে বাড়ির উঠানে, টিনের ঘরের চালে বা পাশের মাঠে রোদে শুকিয়ে ঘরে তুলতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন মরিচ চাষিরা।
কম জমিতে চাষ করে অধিক লাভবান হওয়ায় প্রতি বছর এই অঞ্চলে বাড়ছে মরিচের আবাদ। গুণে, মানে আর দামে বাজিমাত করেছেন চাষিরা। অনেকের ভাগ্যও গেছে বদলে। পঞ্চগড়ের মরিচের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। আর লাল মরিচের নাম হয়ে গেছে লাল সোনা। মরিচের আবাদ কেন্দ্রিক মৌসুমি কৃষিভিত্তিক কর্মসংস্থান হলেও শ্রমিকরা বলছেন ন্যায্য মজুরিও নেই তাদের। কোন এলাকায় কেজি দরে আবার কোন এলাকায় বস্তার দামে এই মৌসুমে কাজ করে হাজারও শ্রমিক। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এ সময়টাতে নেমে পড়ে মরিচ তোলার কাজে।
কিন্তু এবার ভাল নেই এই লাল সোনার মালিকরা। লাভ তো দূরের কথা; এবার উৎপাদন খরচ উঠাতেই দুশ্চিন্তায় মরিচ চাষিরা। পোকার আক্রমণে এবার দিশেহারা হয়েছে কৃষক। এসব পোকা দমনে তাদের অনেক টাকার ওষুধ স্প্রে করতে হয়েছে। অনেকে আবার নাম সর্বস্ব কোম্পানির ওষুধ কিনে হয়েছেন প্রতারিত। হাজার টাকার ওষুধ স্প্রে করেও ক্ষেতের পোকা দমাতে পারেনি অনেকেই। কৃষি কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার অভিযোগ করেছেন অনেকে।
এ কারণে আগের বছরের চেয়ে এবার ফলন নেমেছে প্রায় অর্ধেকে। আর প্রয়োজনের সময় আকাশের বৃষ্টি না হওয়ায় জমিতে সেচ দিতে হয়েছে কয়েকবার। সবমিলিয়ে এবার উৎপাদন খরচ পড়েছে প্রায় দ্বিগুন। সেই সাথে ধকল রয়েছে পাকা মরিচ শুকাতে। বৃষ্টি বা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে এবার রোগের পরিমাণ অনেক কম। আর যে রোদ থাকছে তাতে নেই উত্তাপ।
আরও পড়ুনজায়গা না থাকায় মাঠের মধ্যেই পলিথিন পেঁচিয়ে রাখছে মরিচ। সামান্য রোদের দেখা মিললেই পলিথিন মেলে শুকোতে দিচ্ছে মরিচ। এত কিছুর পরও কৃষকদের মাথা ঘুরছে শুকনো মরিচের বাজারের দিকে চেয়ে। গত বছর যে মরিচ প্রতি মণ বিক্রি হয়েছিল ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা দরে। সেই মরিচ এবার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা মণ দরে। তার মানে আগের বছরের চেয়ে এবার শুকনো মরিচের দাম প্রায় অর্ধেক।
এ নিয়ে কথা হলো পঞ্চগড় সদরের ধাক্কামারা ইউনিয়নের খানপুকুর গ্রামের কৃষক খতিবর রহমানের সাথে। তিনি জানালেন, গত মৌসুমে তিনি মাত্র ২৭ শতক জমিতে মরিচ আবাদ করেছিলেন। সেই জমি থেকে ৭২ হাজার টাকার মরিচ বিক্রি করতে পেরেছিলেন। খরচ বাদে তার লাভ হয়েছিল ৫০ হাজার টাকার মত। এবার আরও বেশি লাভের আশায় তিনি দুই বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছেন। কিন্তু বিধি বাম। কীটনাশক, সেচ ও পরিচর্যায় এখন পযন্ত তার খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকার মত। যে হারে মরিচ তোলা হচ্ছে তাতে করে ১৬ মণের ওপর শুকনো মরিচ হবে না। বর্তমান বাজার অনুযায়ী সব মরিচ বিক্রি করলেও তার খরচের টাকাই উঠবে না।
জেলা কৃষি সম্প্রারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, পঞ্চগড়ের মাটি ও আবহাওয়া মরিচ চাষের উপযোগী। এ কারণে দেশের সর্ব উত্তরের এই জেলাটিতে উৎপাদিত মরিচ কৃষি অর্থনীতিতে বড় জায়গা করে নিয়েছে।
মরিচ চাষে লাভ ভালো পাওয়ায় অর্থকরী ফসল হিসেবে বেছে নিয়েছে কৃষকরা। চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে মরিচ। এ বছর ৮ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত চাষিরা আবাদ করেছেন ৯ হাজার ১৪৫ হেক্টর জমিতে। তবে বাজারে এবার দাম কিছুটা কম থাকায় কৃষকরা কম লাভবান হবেন বলে তিনি জানান।
মন্তব্য করুন