ভিডিও শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

রংতুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব থেকে উদ্যোক্তা হলেন প্রমি

রংতুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব থেকে উদ্যোক্তা হলেন প্রমি

নিজের আলোয় ডেস্ক ঃ ছাটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি, রংতুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রমির। সময় পেলেই রংতুলি নিয়ে বসে যেত সে। তখন থেকেই ফ্যাশন বা ড্রেস ডিজাইনের প্রতি ছিল তার বরাবরই আকর্ষণ। 

প্রমির পুরো নাম তানজিনা ইয়াসমিন প্রমি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী। ছোট বেলা থেকেই প্রমি ক্রফটিং করে আর কাগজ কাপড় ক্লে হাতের কাছে থাকা বিভিন্ন ফেলনা জিনিস দিয়ে এটা সেটা বানাতেন । সেগুলো এক, একজন এসে পছন্দ করতো তিনি গিফট করে দিতেন। ইউটিউব থেকে দেখে দেখে অনেক কিছু বানাতেন। চারুকলায় পড়ার সুবাদে রঙ বিভিন্ন ধরনের ম্যাটেরিয়ালস সম্পর্কে ধারণা জন্মে এবং সেখান থেকেই নিজে নিজে কাজগুলো করতে করতে শেখা হয়েছে। এর বিনিময়ে যে কখনো টাকা নিবেন এমন চিন্তা আসেনি প্রমির।

নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তা প্রমি। প্রথমে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তার। পরিবারের বিপরীতে গিয়ে চারুকলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর নিজে  উদ্যোক্তা হওয়ার পরিকল্পনা করেন। তিনি দেখতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধবীরা যার যার মতো উদ্যোগী হওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কেউ পোশাক, কেউ বা ড্রাই ফুডস, কেউ হ্যান্ড পেইন্টেড ড্রেস, কেউ বা কসমেটিকস আইটেম ইত্যাদি অনলাইনে বিক্রি করছেন। তিনিও তাদের পথ অনুসরণ করলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি অনলাইনে পোশাক ব্যবসা শুরু করলেন।

প্রমির জন্য প্রথমে ব্যবসা করাটা সহজ ছিল না। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে ভর্তি হয়। একে তো পুঁজি নেই, তার ওপর পরিবারের অমতে চারুকলায় ভর্তি হয়েছেন। তখনি তার মনে জেদ চেপে বসেছিল, এখন থেকে পড়াশুনার কোনো খরচ পরিবার থেকে নিবেন না। শুরুর দিকে কোনো টিউশনও পাচ্ছিলেন না। জমানো কিছু টাকা ছিল যা দিয়ে টেনে টুনে এক মাস যায়। একটা আর্নিং সোর্স খুব দরকার ছিল। সেখান থেকেই বিজনেস আইডিয়া মাথায় আসে।
 

প্রথমে তার মাথায় যেই আইডিয়াটা আসে সেটা হলো মাটির জিনিস পত্র বানানো। চারুকলায়  জুয়েলারী বানানোর জন্য উপযোগী মাটি ছিল।  সেখান থেকে প্রথম প্রথম মাটির তৈরি গহনা বানিয়ে নিজের আইডিতে পোস্ট দিতেন। এসব দেখে তার এক বান্ধবী পহেলা বৈশাখের জন্য একটা গয়না কাস্টোমাইজ অর্ডার দেয়। প্রমি জানতেন না যে ওইগুলো কাঠের গয়না। আরেক বান্ধবীর পরামর্শে চট্টগ্রামের একটা পাইকারি মার্কেট আছে যেখানে কাঠের ম্যাটেরিয়ালস পাওয়া যায়। সেগুলো দিয়ে জুয়েলারি বানানো হয়। প্রমি সেই দোকানে গিয়ে ৫৭০ টাকার কাঠের ম্যাটেরিয়ালস কেনেন। এটা ছিল তার প্রথম ইনভেস্ট।

এখান থেকে ব্যবসার সূচনা। দ্বিতীয় বার এক বন্ধু থেকে ১৬শ’ টাকা ধার করে পুনরায় ইনভেস্ট করেন। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। লাভের অংশটা দিয়েই প্রমি জিনিসপত্র কিনতেন। এভাবে করতে করতে এখন তার মাসিক আয় ২০-৩০ হাজার টাকা। তবে কখনো কখনো এর থেকে কম-বেশি হয়। তার পণ্যগুলো শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, দেশের বাইরের ক্রেতারা অনলাইনে পণ্য অর্ডার দিচ্ছে।  যে মাসগুলোতে প্রোগ্রাম বেশি থাকে সে মাসে আরো বেশি সেল হয়। প্রমি বলেন, আমি যখন এই বিজনেসটা শুরু করি তখন কাঠের জুয়েলারী বানাতো এমন মানুষ খুব কম ছিলো। চারুকলায় এক দুইজন বানাতো। এরপর যখন দেখি আমার সিনিয়র কয়েকজন সেম জিনিস নিয়ে বিজনেস করেন আমার বিজনেস আইডিয়াটা চেঞ্জ করি। আমার সব সময় ইউনিক কিছু করতে ভালো লাগে। তখন আমি আর্টিফিসিয়াল ফুল দিয়ে গায়ে হলুদের গয়না বানানো শুরু করলাম এরমধ্যে করোনায় হঠাৎ করে সব থমকে গেলো।

ম্যাটেরিয়ালস কিনতে বাইরে যেতে পারছি না। আমার ‘রঙ’ নামে একটা পেজ ছিল। পেজটা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সে সময়ে বাসায় আগে থেকে কিনে রাখা কিছু কুশি সুতা ছিলো। ইউটিউব দেখে দেখে সেই বন্দি জীবনকে একটু কর্মঠ করতে কুশি কাজ শেখা শুরু করলাম। বাচ্চাদের কুশি জুতা, জামার গলা, কুশি লেস কুশি জুয়েলারী অনেক কিছু বানিয়েছি। এটাও আমার ব্যাবসার একটা অংশীদার হয়ে গেলো।

আরও পড়ুন

প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন কি-না জানতে চাইলে বলেন, ‘একজন নারী উদ্যোক্তার লড়াইয়ের গল্প বলতে গেলে আসলে ঠিকঠাক বলা যায় না। কারণ, কেবল লড়াইয়ের সময়গুলোতে সমস্যার মুখোমুখি হলে অনুভূতিগুলো অনুভব করা যায়। একদিন আমার ‘রঙ’পেজটা হ্যাক হয়ে সব শেষ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। নতুন পেজ খোলার চিন্তা ভাবনা করছি সেই সময়ে পুরনো ‘রঙ’ পেজ টা ফেরত পেলাম। সেখানেই আবার শুরু করলাম। তবে হ্যাক হওয়ায় রিচ কমে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। নিজের আইডিতেই বিজনেস রিলেটেড সবকিছু পোস্ট করতাম।

আর পরিচিত মানুষজনই আমার কাছ থেকে জিনিস কিনতো। বড় ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। ছোটখাটো যেসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল, সেসব কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।

মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রামগুলোতে স্টল দেই। এরপর আমি ব্লক আর বাটিক করবো চিন্তা করি। যেই ভাবা সেই কাজ ইউটিউব দেখে এটাও শিখে ফেললাম। এসব কাজ আমি নিজের ভালো লাগা থেকে শিখেছি কিন্তু আমার কাজ দেখে আমার কাছ থেকে প্রোডাক্ট কিনতে চাইতো সবাই। সেভাবেই এগুলো আমার বিজনেসের প্রোডাক্ট হয়ে গেছে। এগুলো ছাড়াও আমি বর্তমানে হুপ আর্ট, ক্যানভাস পেইন্টিং, লিপ্পান আর্ট, ওয়াল পেইন্টিং, হ্যান্ড পেইন্ট শাড়ি, পাঞ্জাবি থ্রি পিস, ব্লক প্রিন্ট শাড়ি পাঞ্জাবি থ্রি পিস, কাপল সেট এসব করে থাকি।
উদ্যোক্তা জীবনের পর্যটকের নিজস্ব একটা ছন্দ থাকে। সে ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে এগিয়ে নেওয়াটাই হল জীবন। সেই জীবন সম্পর্কে প্রমি বলেন, এক কাজে মিশ্র একটা অনুভূতি আছে। অনেক ভালো লাগে, যখন নিজের কাজ সম্পর্কে ভালো কোনো কথা শুনি। কখনো কাজের চাপে হাঁপিয়ে উঠি, হতাশা চলে আসে। তারপর আবার একটা ভালো খবর শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। এই তো, এভাবেই কেটে যাচ্ছে উদ্যোক্তা জীবনের দিনগুলি।’
উদ্যোক্তা জীবন মানেই ভালো-মন্দের সঙ্গে মানিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। সমাজে টিকে থাকতে হলে একজন নারী উদ্যোক্তাকে সামাজিকভাবে বহু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সময়ে-অসময়ে অনলাইনে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। অনেকের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার জীবন মোটেও সুখকর বিষয় হয় না। প্রতিনিয়ত লড়াই করে ব্যবসার কাজকে টিকিয়ে রাখতে হয়।

নিজের উদ্যোগের বিষয়ে প্রমি বলেন, ‘সমাজের অনেক নারীই উদ্যোক্তা হতে চান, কিন্তু উদ্যোগ থাকলেও সুযোগ হচ্ছে না। আমি তাদের উদ্যোগকে ছড়িয়ে দিতে চাই। এ কারণেই আমার স্বপ্ন নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা, যারা সফল হয়ে অবদান রাখবেন দেশের অর্থনীতিতে। পাশাপাশি নিজেও হবো একজন সফল উদ্যোক্তা। বর্তমানে বেকারত্ব বেড়েই চলছে। তবে আমি কিছুটা সফলও হয়েছি। আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমে অনেক নারীর আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটাই আমার কাছে চরম পাওয়া।
আমার স্বপ্ন একদিন নিজের একটা আউটলেট হবে আর দেশে অনেক নারী আছে যাদের কিছু করার ইচ্ছে আছে কিন্তু  ঘর থেকে বের হতে পারে না সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য। তাদেরকে বাড়িতে বসেই তাদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করে দেয়া। আমি চাই আমার প্রোডাক্টে সব সময় হাতের ছোঁয়া থাকুক।

 

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মারক্রাম ও বাভুমার শক্ত জুটিতে ট্রফি জয়ের পথে দক্ষিণ আফ্রিকা

বগুড়ার ধুনটে পাকা সড়ক ভেঙে পুকুরে বিলীন, ঈদ যাত্রায় ভোগান্তি

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে বিয়ে বাড়িতে আদিবাসী কিশোরী গণধর্ষণের শিকার, গ্রেফতার ২

বগুড়ায় ইসমাইল আকন্দ নামের এক যুবক ছুরিকাহত

বগুড়ার সোনাতলায় ১১ মামলার পলাতক আসামি মোশারফ গ্রেফতার

বগুড়ার শেরপুরে সুদের টাকার জন্য নিয়ে যাওয়া গাভীটি ফেরত পেলেন অঞ্জনা রাণী