কৃষিতে বিষ, চরম ঝুঁকিতে মানবস্বাস্থ্য

স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশের কৃষিতে সাধারণত তিনটি প্রধান কৃষি মৌসুমে বিভক্ত-রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২। এই তিনটির মধ্যে চলমান খরিপ-১ মৌসুমটি বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই মৌসুমে-আউশ, পাট, ভুট্টা, ঝিঙা, পটল, বেগুন, করলা, ঢেঁড়স, বরবটিসহ নানা ধরনের সবজি চাষাবাদ হয়ে থাকে। খরিপ-১ মৌসুম সাধারণত মার্চ থেকে জুন-জুলাই পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে, যা গ্রীষ্মকালীন মৌসুম নামেও পরিচিত।
এ মৌসুমে মাঝারি বৃষ্টিপাত হয় এবং মৌসুমের শেষের দিকে বেশি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টির আশঙ্কাও থাকে। এসময় তাপমাত্রা খুব বেশি এবং বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ মাঝারি থাকে। এরকম বৈচিত্রময় আবহাওয়ার কারণে কৃষিতে ফসল উৎপাদন হয় অন্য মৌসুমের তুলনায় কষ্টকর।
এরকম বৈরী আবহাওয়ায় ফসলে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিতে ব্যাপকহারে ব্যবহার হচ্ছে কীটনাশক। কীটনাশকের ব্যবহারে মানা হচ্ছে না কোন নিয়মনীতি। এর যথেচ্ছা ব্যবহারে জনস্বাস্থ্য যেমন হুমকিতে পড়ছে তেমনি নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরতা শক্তি। বছরে কেবল কৃষি জমিতেই ব্যবহার করা হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার টন কীটনাশক, যার বড় একটি অংশ কোন না কোনভাবে যাচ্ছে মানবদেহে।
দেশে অসংখ্য মানহীন নিষিদ্ধ বালাইনাশকের (পেস্টিসাইড) কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরা। আবার ডিলারনির্ভর ব্যবসায়ীরা ‘লাভের গুড়’ খাওয়ার আশায় নানা উপায়ে বিদেশ থেকে নিম্নমানের বালাইনাশক দেশে আনছেন। অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানির পর দেশে প্রক্রিয়াজাত করে বিপণন করা কীটনাশকের মান অনেক সময় ঠিক থাকছে না।
এছাড়া একটি অসাধু সিন্ডিকেট নকল কীটনাশক তৈরি করে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বৈধ কোম্পানির কীটনাশকের দামও বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। ফলে উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেকই খরচ হয়ে যাচ্ছে কীটনাশকের পেছনে।
বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশন’র (বিসিপিএ) তথ্যমতে, গত কয়েক বছরের ব্যবধানে দেশে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ, পরিমাণে যা সাড়ে পাঁচ হাজার টন। দেশে বালাইনাশকের বাজার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার। দানাদার বাদে তরল ও গুঁড়া বালাইনাশকের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়।
আরও পড়ুনকৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়া কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় সোয়া ২ লাখ হেক্টর। এরমধ্যে খরিপ-১ মৌসুমে সবজি চাষের জন্য জমির লক্ষ্যমাত্র প্রায় ১ লাখ হেক্টর। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেগুন, পটল, বরবটিসহ মাটির উপরিভাগে উৎপাদিত ফসলে পোকামাকরের আক্রমণ বেশি। এতে কীটনাশক প্রয়োগও বেশি হয়।
এছাড়াও উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজে ফলনের দ্রুত বৃদ্ধিতে কীটনাশকের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯ দশমিক ৭ ভাগ কৃষক রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর পরামর্শ পেয়ে থাকেন। ৮০ দশমিক ৩ ভাগ কৃষকের কাছে এখনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর পরামর্শ পৌঁছায়নি।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলা শারোটিয়া এলাকার কৃষক বেলাল হোসেন বলেন, এক যুগ আগেও সবজি ক্ষেতে দুই সপ্তাহে একবার কীটনাশক ছিটালেই হতো। বর্তমানে পোকা আর রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়েছে। দু’দিন পরপর জমিতে কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। কীটনাশক ছিটানোর পরপরই কোন কোন জমি থেকে সবজি তুলে বাজারে নিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার সময় কই?
আরেক কৃষক গফুর মিয়া বলেন, এবার বেগুন চাষে দু’দিন পর পর কীটনাশক স্প্রে করতে হচ্ছে। কীটনাশক স্প্রে না করলে প্রত্যাশিত ফসল পাওয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, আগের চেয়ে ফসল উৎপাদনে খরচ বেড়েছে, ফলে জমি থেকে কাঙ্খিত ফলন না তুলতে না পারলে ব্যর্থ পরিশ্রমের সাথে লোকসানও গুণতে হয়।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান বলেন, বগুড়ার কৃষকেরা সবজিক্ষেতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করেন এটা যেমন ঠিক তেমনি কীটনাশক ব্যবহার কমাতে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মূলত বেশিরভাগ কৃষক দ্রুত ও বেশি ফসল পাওয়ার আশায় কীটনাশক ব্যবহারে ঝুঁকছেন। তিনি আরও বলেন, ফসলে কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে জৈব কীটনাশক এবং কীটপতঙ্গ দমনের প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষকদের নানাভাবে সচেতন করা হচ্ছে। তবে কৃষিতে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের কীটনাশক ব্যবহার বন্ধে কৃষি বিভাগের ক্ষমতা ও জনবল সীমিত।
মন্তব্য করুন