হাসান মোঃ শাব্বির
তিতাসের দোকান, করতোয়া ও পেপসি

বগুড়া সাতমাথা থেকে কাহালু সদরের দূরত্ব ৮ কিমি এর কিছু বেশি। আমাদের গ্রাম শীতলাই, কাহালু থানা সদরের বেশকিছু আগে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ মিশ্র পেশাজীবী। শিক্ষাব্যবস্থা কেবলমাত্র গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এবতেদায়ী মাদরাসা আর পার্শ্ববর্তী এলাকায় হাইস্কুলের ওপর নির্ভরশীল নয়। কাহালুতে বেসরকারি অনেকগুলো কিন্ডারগার্টেন প্রাক স্কুল, বালক-বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, মহিলা কলেজ, আলিম মাদরাসা নব্বইয়ের দশক থেকেই ছিলো।
সাধারণ মানুষের মাঝে তথ্য প্রবাহে তখন শক্ত ভূমিকা রাখতো রেডিও, বিটিভি আর দৈনিক করতোয়া। আমাদের গ্রামসহ বেশিরভাগ গ্রামের তরুণ-যুবকদের যারা হাইস্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন তারা পত্রিকার পাঠক ছিলেন নিয়মিত। সেসময় পত্রিকা যে বাড়িতে নেওয়া হতো তা রীতিমতো সম্ভ্রান্তের পরিচয় বহন করত কিংবা নিন্দুকরা বাঁকাচোখে দেখতো। কৃষকের সন্তান ছিলেন আমার বাবা।
শিক্ষাজীবন শেষে প্রতিষ্ঠা করেন দরগাহাট ডিগ্রী কলেজ। আমাদের গ্রামের সেসময়ের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত কৃতী, মেধাবী ছাত্র। বাড়িতে আনা হলো ন্যাশনাল সাদাকালো টিভি আর আমার বড় প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে পত্রিকা নেওয়া।
আমার কোন চাচা ছিলেন না। দাদার পাঁচ সন্তানের একমাত্র পুত্র সন্তানের নাতি। আমাকে মাটিতে রাখে না পিঁপড়ায় কামড়াবে আর বিছানায় রাখে না মশায় কামড়াবে এমন একটা অবস্থা। পড়াশোনার চাইতে আবদার পূরণেই ব্যস্ত সবাই আমার ছোট ফুপি ছিলেন সদ্য ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজের শিক্ষার্থী তখনও ম্যাট্রিককে এসএসসি বলা শুরু হয় নি, কাগজে কলমে এসএসসি বললেও ম্যাট্রিক অধিক প্রচলিত ছিলো। বাবার বয়সে ছোট পাড়ার সবাই আমার চাচা। তাদের সাথে নিয়মিত স্কুল মাঠ, ক্লাব আর তিতাসের দোকানের আমি একজন শিশুসদস্য।
তিতাস চাচা ছিলেন আমাদের গ্রামেরই পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের ছোট ছেলে। তিনি একজন উদ্যোক্তা ছিলেন। তখনকার দিনে ‘উদ্যোক্তা’ সনাতনী চাকুরি ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো কিংবা কৃষি কাজ না করে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টাকে পন্ডশ্রম বা খামখেয়ালি বলে গণ্য করা হতো। তিতাস চাচার দোকানের পাশেই ছিলো শীতলাই সেঞ্চুরিয়ান, সূর্যসেনা আর টাইগার ক্লাব। অনৈক্য, রাজনৈতিক শক্তির লড়াই আর প্রভাব বিস্তার প্রদর্শনের অন্যতম হাতিয়ার ছিলো এসব ক্লাব।
আমাদেরও গ্রামও সেসবের ব্যতিক্রম নয়। তিতাস চাচা আমাদের গ্রামের এমন আরও কয়েকটি ক্লাবের সদস্য না হলেও সব ক্লাবের সদস্য তার দোকানের খাস গ্রাহক ছিলো। নাবিস্কোর আটআনার চকলেট, হাজমলা থেকে শুরু করে হরেক পদের শিশুদের মুখরোচক খাবার, বিড়ি সিগারেট, পান আর পেপসি ছিলো প্রধান আকর্ষণ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্রই পাওয়া যেতো তিতাস চাচার দোকানে।
শুক্রবার সকালে রীতিমতো তিতাসের দোকানে বিশাল জটলা। বিষয় কি? ঘড়ির কাঁটায় ৯ টা কিন্তু রশিদ হকার এখনও আজকের পেপার দিয়ে যায় নি। চারদিকে মুরুব্বিদের কানাঘষা দেশের রাজনৈতিক হাল হকিকত নিয়ে, চাচা সমাজের চিন্তা খেলার খবর নিয়ে। ফুটবলের জনপ্রিয়তা শীর্ষে, ক্রিকেটের কদর তখন হাতেগোনা। আমাদের পাশের গ্রাম উলট্ট। সেখানে আমাদের পাড়ার এক ফুপির শ্বশুরবাড়িতে আমরা পাড়ার চাচা-জ্যেঠোদের সাথে যেতাম ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে।
বিশ্বকাপের ছাপানো ফিকশ্চার, ইফতার-সেহারীর সময়সূচী,পরীক্ষার রুটিন, চাকুরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য পত্রিকার কদর ছিলো ভিন্নমাত্রার। ‘করতোয়া’ পত্রিকা ঘিরে সেসময় আলাদা একটা ক্রেজ ছিলে তিতাসের দোকানে দোকানির চাইতেও পাঠক হিসাবে তিনি ছিলেন অনন্য। সব খবর পছন্দ করতেন। আসলে তিনি জানতে, পড়তে আর জানাতে পছন্দ করতেন। দৈনিক করতোয়াকে ঘিরে আমাদের শীতলাই পশ্চিম পাড়ার এই তিতাসের দোকান হয়ে উঠেছিলো অঘোষিত রিডার্স ক্লাব।
জাহিদুল ভাই ধনী ঘরের ছোট ছেলে। তিতাসের দোকানের শোভন শ্রেণির গ্রাহক। লুৎফর ভাই, ইত্তাজুল চাচা, জহুরুল ভাই, পেস্তা ভাই, টিক্কা ভাইদের সাথে তিতাস চাচার দোকানে যেতে যেতে ‘পপসি’ খাওয়ার বিলাশিতা হতো মাঝে মাঝেই। লুৎফর আর টিক্কা ভাই ছিলেন সোহদর। বয়সে বড় টিক্কা ভাই বেশি টাকা দিতেন আমি আর লুৎফর ভাই ভবিষ্যতে হাতে টাকা আসলে টিক্কা ভাইকে খাওয়াবো এমন প্রতিশ্রুতিতে ‘পেপসি’ খেতাম আর ভাইয়ের কন্ঠে পত্রিকা পাঠ শুনতাম।
আরও পড়ুনএকবার হলো কি, সম্ভবত আমরা তখন শহরে ভাড়াবাসায় চলে আসছি। গ্রামে শুক্রবার সকালে যেয়ে চাচাতো ভাই সালাম, শামীম, রব্বানীদের সাথে তিতাসের দোকান যেয়ে কয়েকভাগে ‘পেপসি’ খেয়ে বিনিময়মূল্য হিসাবে সেদিনের ছাপানো করতোয়া সহ আরও কয়েকটি ম্যাগাজিন দিয়ে আসছি। তাজা পত্রিকা মানে বিশাল ব্যাপার ঐ দিন আর গাঁটেরপয়সা খরচ করে পেপার কেনা লাগলো না তিতাস চাচার!
আমাদের বাড়িতে অবশ্য ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই টের পেয়ে যায় ঘটনা কি, তিতাস চাচা নিজেই আবার আমাদের বাড়িতে যেয়ে দিয়ে এসেছিলেন। তাছাড়া সালমান শাহ, শাবনূর, অঞ্জু ঘোষ, ইলিয়াস কাঞ্চন, পপি, শাকিল খান, ওমর সানি, মৌসুমি, শাবানা, সোহেল খান, দীতি, টনি ডায়েস, নোভেল, মৌ, জাহিদ হাসানসহ বিনোদনের নানা তারকাদের ছবি সংগ্রহ করে সেদিনের ছাপানো সংশ্লিষ্ট খবর বা পেপার কাটিং সংগ্রহ করা ছিলো আমার ফুপির নিত্যদিনের কাজ আর আমি ছিলাম তার সাগরেদ।
প্রতিদিন সকালে শুধু আমাদের গ্রাম কেন কাহালু উপজেলার তথ্য প্রবাহে ভূমিকা রাখতো দৈনিক করতোয়া। টিভি, মোবাইল থাকলেও ক্যাবল কানেকশন, ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিলো না। আর খবর তখনও বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয় হয় নি। রশিদ হকারের মতো এমন অনেককেই তখন অফিস আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর কয়েকটি থানা সদরের বাড়িতে পত্রিকা পৌঁছাতে হতো। সময়ের বিবর্তনে এখন কাল সকালে ছাপা পত্রিকায় পাঠক কি পড়বে তা মধ্যরাতে ই পেপারে অনলাইনে পড়া যায়। ওয়েবসাইটে তো চব্বিশ ঘণ্টা আপডেট পাওয়া যাচ্ছেই।
জীবনের নানা গল্প, হাসি ঠাট্টা, তর্ক বিতর্ক যেন করতোয়া নদীর মতোই বহমান। প্রাচীনকালের খরস্রোতা করতোয়া যেমন এখন শুধুই কাগুজে নদী। তার জৌলুশ ফেরাতে বাঁধতে হয় দু’পাড়, ড্রেজার দিয়ে খুঁড়ে ফেরানোর চেষ্টা এর নাব্যতা। ঠিক তেমন দৈনিক করতোয়াও পাঠকদের নাশতার কিংবা অফিসের বড়বাবুদের অছ্যুত টেবিল আর টং দোকানের চায়ের আড্ডা থেকে পৌঁছে গেছে তাদের মুঠোফোনে। ছাপা থেকে অনলাইন দীর্ঘ সময়ে নিজেকে আরও গুছিয়ে নিয়েছে দৈনিক করতোয়া।
দৈনিক করতোয়া এখন পঞ্চাশের পূর্ণ এক বটবৃক্ষ। অফলাইন, অনলাইন দুইভাবেই মানুষের হাতে। নানা প্রয়োজনে এখন গ্রামে যাওয়া হয় মাঝে মাঝে। ভাই-ভাতিজাদের দেখি মোবাইলেই খবর দেখে, শোনে, শোনায়। শৈশব থেকে এখন সন্তানের বাবা।
পাঠক থেকে এখন আমি দৈনিক করতোয়ার একজন কলম সৈনিক, কর্মী। খুব করে চাই পৃথিবীতে বই, ছাপানো পত্রিকা রয়ে যায়। সময়ের প্রয়োজনে অনলাইনে হয়তো আরও নতুনত্ব আনবে, আসবে কিন্তু তিতাসের দোকানের অনাগত কোন কিশোরের জীবনে টাটকা করতোয়া দিয়ে একটা পেপসির কাঁচের বোতল পাওয়া নিয়ে নতুন কোন গল্প তৈরি হবে না। জন্মদিনের শুভেচ্ছা, দৈনিক করতোয়া। এগিয়ে যাও স্ব-মহিমায়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, বগুড়া।
সাব-এডিটর দৈনিক করতোয়া অনলাইন
মন্তব্য করুন