বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশন সুবিধা
সারাদেশে প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও কলেজসহ প্রায় ২৬টি সংগঠনের ৯ লাখের মতো শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। তার মধ্যে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় কর্মরত আছেন ৫ লাখের মতো। এই জনগোষ্ঠীর দুঃখের শেষ নাই। বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশন নাই, মাত্র ১০০০ টাকা তাঁরা বাসা ভাড়া পায়, মাত্র ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পায়। তাঁদের বেতন অতি স্বল্প, যা প্রকাশ করা যায় না। দুটি ঈদ উৎসব ভাতা পায় মূল বেতনের মাত্র ২৫%।
একই কর্মঘন্টা ও সিলেবাস পড়িয়েও তাঁরা সরকারি কলেজের শিক্ষকদের মতে পেনশন, বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পায় না। চাকরি থেকে অবসরের পর বেসরকারি শিক্ষকরা অবসর ও কল্যাণ নামক দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরকালিন টাকা পায়। কিন্তু সে টাকা পেতেও তাঁদের ৩/৪ বছর লেগে যায়। আমি আমার শহরে অবসরে যাওয়া কিছু শিক্ষককে চিনি যারা অবসরে যাওয়ার পরও ২/৩ বছরে কোন অবসর ভাতা পাননি।
পত্রিকায় এমনও খবর পাওয়া যায় অবসর না পেয়েও কোন কোন শিক্ষক মারা গেছেন। এত এত দুঃখ, কষ্ট নিয়ে তাঁরা চাকুরী করে। তাহলে এই পেশায় আর কোন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ আসতে চাইবে! আবার তাঁদের এই স্বল্প বেতন থেকেও ১০% টাকা প্রতি মাসে অবসর ও কল্যাণ খাতে কেটে নেওয় হয়। সেই টাকা কত পরিমাণ তা শিক্ষকরা কোনদিন জানতে পারে না। এসব চলছে বছরের পর বছর। বড় অংকের টাকা ছাড়া এই রাজ্যে চাকুরী হয় না।
সবাই বলে আমরা শিক্ষকবান্ধব। ’শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’, শিক্ষকরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সব সুবচন এখন নির্বাসনে চলে গেছে। কোন সুখবর নেই এই শ্রেণীর মানুষদের। বেদনায় নীল হয়ে গেছে তাঁদের জীবন। সন্তান, স্ত্রীর, স্বজনদের কাছে তাঁরা ছোট হয়ে যায়। একজন বেসরকারি সহকারী অধ্যাপক ঈদ উৎসব ভাতা পায় ১০ হাজার টাকার মত।
এই টাকা দিয়ে কুরবানি হয় ভাই? না সন্তানদের কাপড় কেনা হয়? তাই ঈদ উৎসবটাও ভালভাবে কাটে না তাঁদের। তাও সেই ভাতা পান তাঁরা ঈদের ২/৪ দিন আগে। পৃথিবীর কোন দেশে এমনটি আছে ? মনে হয় নেই। গত ৩০ বছর নিবিড়ভাবে এই স্তরের শিক্ষকদের খুব কাছে থেকে দেখেছি।
সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের বেশি। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণ সুবিধা দেওয়া হয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে কল্যাণের সুবিধা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাষ্টের মাধ্যমে। আর অবসর সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও অবসর সুবিধা কল্যাণের মাধ্যমে।
একজন শিক্ষকের ৬০ বছর পূর্ণ হলে তাকে অবসরে যেতে হয়। অবসরে যাওয়া কোন শিক্ষকের সহকর্মীরা কিছু চাঁদা তুলে বিদায়ের দিনে সেই শিক্ষককে কিছু উপহার দেন। কিন্তু একজন শিক্ষক যে প্রতিষ্ঠানে ৩০ বছর চাকরি করলো, অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাকে কোন কিছুই দেয় না।
কেউ কেউ টাকা দেন কিছু। অবসরের পর দিন থেকে সেই শিক্ষক হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ, একা, অনাহুত। প্রচন্ড অর্থকষ্ট তাঁকে পেয়ে বসে। কারো কারো নিত্যদিনের ওষুধ কেনার টাকাও থাকে না। একটা সংবাদপত্র কেনার টাকাও থাকে না তার কাছে। অবশ্য যার অর্থবিত্ত আছে, তার কথা আলাদা। সমাজে. সংসারে, স্বজনদের কাছেও তিনি ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। কি কষ্ট? কেউ ভাবে না।
আরও পড়ুনঅবসর সুবিধা বোর্ডের সূত্র মতে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৭ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আবেদন করে অবসর ভাতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা দেওয়া আবেদনগুলোর নিরীক্ষা (অডিট) নিষ্পত্তি করা হয়েছে। কিন্তু তহবিলের অভাবে শিক্ষকদের টাকা দেওয়া যাচ্ছে না।
সর্বশেষ ২০২০ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত জমা হওয়া আবেদনগুলোর বিপরীতে অবসর সুবিধার টাকা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে কল্যাণ ট্রাষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কল্যাণ সুবিধার জন্য প্রায় ৩১ হাজার আবেদন জমা আছে। এর মধ্যে এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আবেদন জমা পড়েছে ১০ হাজার ২৪২টি। বর্তমানে জমা হওয়া ৩৭ হাজার আবেদন নিস্পত্তি করতে প্রয়োজন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।
বর্তমান সরকার এই স্তরের শিক্ষকদের জন্য ইফটি প্রথা চালু করছে। ঘোষণা হওয়া মহার্ঘ ভাতাও তারা পাবেন হয়তো। বর্তমান এই স্তরের শিক্ষকরা শতভাগ বেতন বা ভাতা পাচ্ছেন। নিজস্ব একাউন্টে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন। তবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখার পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন ও অনান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। এই পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলার কোন বিকল্প নেই। বিকল্প নেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও আকর্ষণীয় করে তোলার। আর কে না জানে শিক্ষা ছাড়া আধাঁর ঠেলা যায় না।
রবিঊল ইসলাম রবীন
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কলামিষ্ট
মন্তব্য করুন