অবৈধ পথে বিদেশ গমন ও মানবপাচার

মানব পাচারের উর্বর ভূমি হিসেবে যেসব দেশকে ভাবা হয়, বাংলাদেশের স্থান তার ওপরের দিকে। মানব পাচারের লজ্জা থেকে বাঁচতে ২০১২ সালে মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হলেও তা বজ্র আটুনি ফসকা গেরোয় পরিণত হয়েছে। উন্নত জীবনের আশায় অবৈধ পথে বিদেশ গমনের খবর বিভিন্ন সময়েই সামনে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বলার অপেক্ষা রাখে না, অবৈধ পথে বিদেশ গমনে নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটে।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বহি: সীমান্ত দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে ঢুকেছেন ৭৫ হাজার ৯০০ জন অভিবাসন প্রত্যাশাী। তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সুরক্ষা সংস্থা ফ্রন্টে এ তথ্য জানিয়েছে। ইতালির সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে দেশটিতে ঢোকা অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষে রয়েছেন।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এবং পশ্চিম আফ্রিকান রুট দিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশী আসার সংখ্যা তীব্রভাবে কমে যাওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনিয়মিত সীমান্ত অতিক্রম গত বছরের প্রথম ছয় মাসের ২০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছেন ফ্রন্টেক্স। সংস্থাটি বলছে, সার্বিকভাবে অভিবাসন প্রত্যাশী আসার হার কমে আসলেও মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় অভিবাসন রুট এখনও ব্যস্ত রয়েছে।
তবে পশ্চিম বলকান, পূর্বস্থল সীমান্ত এবং পশ্চিম আফ্রিকান অভিবাসন রুট দিয়ে আসা অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যা তীব্রভাবে কমেছে। ফ্রন্টেক্স বলেছে, প্রথম ছয় মাসে আসা অভিবাসীদের মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশিরা। এরপরই আছেন মিসর ও আফগানিস্তানের নাগরিকরা। পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় অভিবাসন রুট দিয়ে আসা অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যা ২৫ ভাগ কমে ১৯ হাজার ৬০০ হয়েছে।
তবে লিবিয়ার উপকূল থেকে গ্রিক দ্বীপ ক্রিট পর্যন্ত নতুন পথ তৈরি হওয়ায় সাম্প্রতিক মাসগুলিতে এই রুটে অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়েছে। ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখা বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে আসা অনিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যা ৩১ হাজার ৯৪৮ জন। এই সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা বেশি। কিন্তু ২০২৩ সালের প্রায় অর্ধেক কম। চলতি বছর ১০ হাজার ৩১১জন বাংলাদেশি পৌঁছেছে ইতালিতে। যা মোট আগমনের ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশের পরই রয়েছে ইরিত্রিয়া। চার হাজার ৪৩১ জন ইরিত্রিয়ান ইতালিতে পৌঁছেছেন। তৃতীয় অবস্থানে থাকা মিসরের নাগরিকের সংখ্যা তিন হাজার ৭২৩।
আরও পড়ুনআমরা বলতে চাই, এই পরিস্থিতি যে দেশের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়, তা সহজেই অনুমান করা যায়। জানা যায়, দালালদের খপ্পরে পড়ে নিশ্চিত বিপদ জেনেও ইউরোপের পথে পা বাড়াচ্ছেন তারা। সব হারিয়ে এখন নি:স্ব তাদের অনেকেই। মৃত্যুর চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনেকেই সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছেন, আর যারা ভাগ্যগুণে বেঁচে যান, তাদের ঠাঁই হয় জেলের অন্ধকার খুপরিতে। আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, বিদেশে যাওয়ার জন্য এমন প্রাণহানি বা বন্দিদশা এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা মনে করি, সামগ্রিক এ পরিস্থিতি বাংলাদেশ সংশ্লিষ্টদের আমলে নিতে হবে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অভাবের তাড়নায় কিংবা পরিবারে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে, উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ থেকে নারী-পুরুষ ও শিশু বিভিন্ন দেশে পাচারের শিকার হচ্ছে এমন বিষয়ও এর আগে খবরে উঠে এসেছে। বিশেষ করে দালালদের খপ্পরে পড়ে নি:স্ব হচ্ছে একের পর এক মানুষ। সঙ্গত কারণেই সার্বিক পরিস্থিতি আমলে নিতে হবে।
সাগর পথে পাড়ি দেওয়া বা অবৈধ পথে নিয়ে যাওয়ার নামে মানবপাচারের ঘটনাও বারবার ঘটেছে। বিভিন্ন দেশে মানব পাচারের ঘটনাতেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে এই উৎকণ্ঠাজনক অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। মনে রাখা দরকার, মানব পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। এ ঘৃণ্য অপরাধে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তবে বেকার যুবকদের উপদেশ দেয়াটা হলো সমস্যার মলমী সমাধান।
অবৈধ উপায়ে বিদেশ যাত্রা ঠেকাতে হলে দেশে চাহিদার অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিকল্প কিছু নেই। জনশক্তি রফতানির আওতা ও পরিসরও বাড়াতে হবে। কম খরচে বেকাররা যাতে ভিন্ন দেশে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ঢুকতে পারে, সে চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে নিরন্তর। সবশেষে, বিশেষত সমুদ্র পথে যাতে বেআইনিভাবে কেউ অন্য কোনো দেশে যেতে না পারে, সে জন্য সমুদ্র সীমানায় প্রতিরোধমূলক যথেষ্ট প্রহরার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মন্তব্য করুন