বগুড়ায় হোটেলে ও বাসাবাড়িতে কচু বিক্রি করে জীবনের চাকা ঘোরে বিউটি বেগমের
হাফিজা বিনা : ‘কচুশাকে ভিটামিন আছে। চোখ ভাল রাখে, প্রেসার কমায়। যাদের রক্ত কম তাদের কচু খাওয়া লাগবি। হার্ডের অসুখ হবিনা।’ কথাগুলো আমার না। বলছিলেন এক অজপাড়া গাঁ থেকে আসা পঞ্চাশোর্ধ এক নারীর। তিনি অন্যের শরীর ভাল রাখার সঠিক পণ্যটি যোগান দিলেও নিজে রীতিমত একজন হার্টের রোগী। বগুড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় তাকে প্রায়ই দেখা যাবে বস্তাতে করে পথের ধারে কিম্বা বাসা বাড়ির আশে-পাশে থেকে কচু সংগ্রহ করছেন।
এই কচু তিনি শহরের বিভিন্ন হোটেলে ও বাসাবাড়িতে বিক্রি করে তার এবং পরিবারের খরচের চাকা ঘোড়ানোর জন্য সামান্য অর্থ আয় করেন। কচুশাক বিক্রি করা এই নারীর নাম বিউটি বেগম। বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা আগুনিয়াতাইড় গ্রামে। স্বামীর নাম জাহেদুল। ১৬ থেকে ১৮ বছর আগে যখন তার বড় ছেলের বয়স আড়াই এবং ছোট ছেলের বয়স ২২ দিন তখন করে স্বামী মারা যান।
দুই সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় তার জীবনের ২য় কষ্টের অধ্যায়। মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করেছেন। দুই মুঠো ভাতের বিনিময়ে। এক সময় ডান হাত ভেঙ্গে যায়। এরপর আর ভারি কোন কাজ করতে পারতেন না। কেউ একজন পরামর্শ দেন কষ্ট না করে গ্রাম থেকে শাক, কলার থোর, অ্যাটে নিয়ে শহরে বিক্রি কর তাহলে অন্তত ছেলেদের সাথে সাথে নিজে বাঁচতে পারবে। সেই শুরু।
এখন তিনি আর গ্রামে থাকেন না। সকালবেলা ট্রেনে অথবা সিএনজিতে চেপে শহরে চলে আসেন। দিনে ভাড়া বাবদ খরচ হয় ৮০ টাকা। এরপর যেসব এলাকায় বসতি কম সেসব এলাকায় কাঁচি বস্তা নিয়ে কচু কাটতে লেগে পড়েন। অনেক দিনের এই কাজের জন্য তিনি খুব ভাল জানেন কখন কোন এলাকায় কচু পাওয়া যাবে। পর্যায়ক্রমে তিনি শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কচু নিয়ে বিক্রি করে আবারও আরেক এলাকায় কচু তোলেন। দিন শেষে কিছু টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরেন বিউটি।
বিউটি জানান, জীবনে অনেক কষ্ট করে বেঁচে আছেন। পরিবারে ছেলে,বউ, নাতি ও তার বৃদ্ধ মাও থাকেন সাথে। আজ পর্যন্ত সরকারি কোন সহযোগিতা মেলেনি। আশে-পাশের অনেকেই অনেক কিছু পেয়েছেন তিনি কিছুই পাননি। বললেন, শরীর আর চলেনা। সকাল বেলা কখনও খেয়ে এবং কখনও না খেয়ে শহরে চলে আসে। কচু তুলে তা বিক্রি করে কখনও খেয়ে নেন সামান্য কিছু।
আরও পড়ুনকোমরে গোজা একটা ছোট বাটুয়ার মধ্যে থেকে একটি ইকোস্প্রিন ট্যাবলেট দেখিয়ে বলেন এই ওষুধটা সবসময় কাছে রাখেন এবং নিয়মিত খেতে বলেছে ডাক্তার। এই অবস্থা নিয়ে সারা শহরময় খুঁজে খুঁজে কচু তুলে একজায়গাতে বসে ছোট ছোট আটি বানান। ২৫ কচু বিক্রি করেন ২শ’ টাকায়। তিনি বলেন, গ্রামে আর কচু পাওয়া যায় না।
শহরে আর শহরতলীতে এখনও কচু পাওয়া যায়। এবং শহরের মানুষ কচু খায় বেশি। এজন্য তিনি শহরে আসেন এবং শহরের হোটেল এবং বাড়িতে এগুলো বিক্রি করেন। তবে শীতের সময় বাসাবাড়িতে কচু কম বিক্রি হয়। ঠান্ডার জন্য অনেকেই কচু খান না। তখন অনেকদিন খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। তিনি বলেন, কচু খেলে অনেক উপকার হয় এটা যারা জানে তারা কচু খান বিভিন্ন উপায়ে।
আমি জানি তাই অনেক বলি সেকথা। কিন্তু নিজের শরীর আস্তে আস্তে খারাপ হচ্ছে। নিজের মাথা গোজার জন্য কিছুই ছিলনা। খেয়ে না খেয়ে একটু টাকা জমিয়ে চার শতক জায়গার টাকা দিয়েছেন কিন্তু এখনও দলিল করতে পারেননি। জীবনের এই সময়ে এসে তিনি সরকারি সাহায্য হিসেবে যেকোন ভাতা’র একটা কার্ড চান জনপ্রতিনিধিদের কাছে।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে নিয়মিত কচু খেলে কোলন ক্যানসার ও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে। সব সময় ডাক্তারের পিছু পিছু না দৌড়ে প্রাকৃতিক সুরক্ষা গ্রহণ করা হলো বুদ্ধিমানের কাজ। কচুতে আছে প্রচুর ফাইবার, ফোলেট ও থায়ামিন, যা মানবদেহের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান। তেমনি প্রয়োজনীয় খুব অল্প চাহিদার এসব মানুষের পাশেও সমাজের বিবেকবান ও দায়িত্বশীলদের দাঁড়ানো।
মন্তব্য করুন