দ্রুত বিচার, ধর্মীয় এবং পারিবারিক শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতাই ধর্ষণকে রুখতে পারে
নারী ও শিশুর প্রতি যৌন সহিংতা বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ

নাসিমা সুলতানা ছুটু : দেশে হঠাৎ করেই ধর্ষণ বিশেষত শিশুদের ওপর যৌন সন্ত্রাস বেড়েছে। গত ৬ মার্চ থেকে পরবর্তী চারদিনে দেশের ১০টি জেলায় ১১টিরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ৪ বছর থেকে ১৪ বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯টি। ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় দেশবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। প্রতিবাদ হচ্ছে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকার ধর্ষণ প্রতিরোধে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। উচ্চ আদালত মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণকান্ডের বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে আছিয়ার পর দেশের আরও কয়েকটি জেলায় শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাবা-মা এবং অভিভাবকরা তাদের মেয়ে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
ফলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মাত্রাও বেড়ে গেছে। ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছেন। কোথাও কোথাও অভিভাবকরাও বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন। এরই মধ্যে গতকাল রোববার ফরিদপুরে এক ধর্ষককে পিটুনিতে হত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে আজ সোমবার (১০ মার্চ) দুপুরে সর্বস্তরের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বগুড়া শহরের সাতমাথায় প্রতীকী ধর্ষকের মাথায় জম টুপি পড়িয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
একইদিনে বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজ এবং বগুড়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরাও ধর্ষকদের গ্রেফতার এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। আগেরদিন রোববার রাতে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থীরাও মশাল নিয়ে মিছিল করেছেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৬ জন নারী ও শিশু। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৭টি। এরমধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৫টি।
ওই দুই মাসের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে বেশি ৫৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছে। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিন কিশোরী ও ১৪ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুই নারী।
এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে। ওই মাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুইটি ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে পাঁচ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন।
গত ৬ মার্চ মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আট বছরের শিশু আছিয়া ধর্ষণের শিকার হয়। ভগ্নিপতি, তার ভাই এবং তাদের বাবা মিলে বর্বরোচিতভাবে ধর্ষণ করে। পরদিন ৭ মার্চ কুমিল্লার লালমাইয়ে চিপস কিনে দেওয়ার কথা বলে বাক প্রতিবন্ধী এক তরুণীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়। ৮ থেকে ৯ মার্চ দুই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও ৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
শিশু ধর্ষণের ঘটনা কেন বাড়ছে তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে করতোয়া। কথা বলেছে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী এবং নারী ও শিশুদের অধিকার এবং তাদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা লোকজনদের সঙ্গে। তারা এ ধরনের জঘন্য ঘটনার পেছনে বিভিন্ন বয়সী পুরুষদের মানসিক অসুস্থতাকেই দায়ী করেছেন। এছাড়া আইনের দুর্বলতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও অনেকাংশে দায়ী বলে উল্লেখ করেছেন।
সচেতন নাগরিকরা মাগুরার ৮ বছর বয়সী শিশু আছিয়া ধর্ষণের উদাহরণ টেনে বলেন, শিশু আছিয়াকে যারা ধর্ষণ করেছে তারা এতটাই বিকৃত রুচির ছিল যে, তার গোপনাঙ্গের গভীরতা বাড়াতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তা খুচিয়েছে পর্যন্ত। একইভাবে তারা একটি ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এক আসামীর জামিন পাওয়ার বিষয়টিও সামনে এনে বলেছেন, দিনাজপুরে ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত এক আসামির ৮ বছরের মাথায় জামিন পাওয়ার বিষয়টি আইনের দুর্বলতাকেই ইঙ্গিত করে।
এছাড়া সমাজে এমন এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যাদের কাছে নারীরা যেন শুধুই ভোগের সামগ্রী। বিকৃত মানসিকতার ওই শ্রেণির মানুষগুলো তাদের চিন্তা-চেতনার ডালপালা সমাজে বিস্তার ঘটিয়েই চলেছে। ফলে ধর্ষণের মত অসামাজিক ঘটনা বেড়েই চলেছে।
নারী এবং শিশুদের অধিকার এবং তাদের সুরক্ষা নিয়ে নানা পর্যায়ে কাজ করা ব্যক্তিবর্গ ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি নারী ও শিশুদের অধিকারের পক্ষে জনসচেতনামূলক ক্যাম্পেইন বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন। জার্মান প্রবাসী তাহসিন তালুকদার তুর্য ছুটিতে ক’দিন আগে দেশে এসেছেন। এরই মধ্যে দেশ জুড়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা তাকে বিচলিত করে তুলেছে।
আরও পড়ুনবগুড়ায় করতোয়ার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘এখন ফেসবুকে নিউজ ফিডে গেলেই এসব নোংরা খবরগুলো ভেসে উঠছে। আমি এগুলো নিতে পারছি না।’ কারণ হিসেবে গত ৬ বছর ধরে জার্মানিতে বসবাসের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তুর্য বলেন, ‘জার্মানিতে এ ধরনের ঘটনা একেবারেই অকল্পনীয়। বরং সেখানে যদি কোন বাবা-মা অথবা কেউ একজন শিশুর সঙ্গে একটু রূঢ় স্বরে কথা বলে তাহলেই সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। কোন শিশু যদি ফোনে অভিযোগ করে তাহলে পুলিশ এসে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রীতিমত গ্রেফতার করে।
সেখানে আমার জন্মভূমিতে শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে-এটা ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে।’ তার মতে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় দ্রুত বিচারের মাধ্যমে অভিযুক্তদের প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া উচিত। তাহলেই এধরনের অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।’ একই ধরনের মন্তব্য করেছেন গতকাল রোববার বগুড়ার সাতমাথায় ধর্ষণ বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিতে আসা একটি বেসরকারি নার্সিং ইন্সটিউটের শিক্ষার্থী, শিফাত মিয়া।
তার মতে যদি কোন ধর্ষকের যদি প্রকাশ্য শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে পরবর্তীতে কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে ভয় পাবে। জার্মান প্রবাসী সমাজকর্মী ও উদ্যোক্তা শাকিলা আনোয়ার মিথিলা অবশ্য মনে করেন আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি নারী ও শিশুদের অধিকার এবং তাদের সুরক্ষার বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করাটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। তার মতে মানসিক বিকৃতিই যেহেতু একজন পুরুষকে ধর্ষণকে রূপান্তরিত করে তাই এ ধরনের বিকৃত মানসিকতা যাতে কারও মধ্যে তৈরি না হয় সেজন্য আমাদের ক্যাম্পেইন করতে হবে।
বগুড়ার বিশিষ্ট গাইনি চিকিৎসক ডা. ফাহমিদা শিরিন নীলা মনে করেন শিশুর প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করাটা মোটেও স্বাভাবিক বিষয় নয়। এটি একটি মানসিক বিকৃতি, যেটাকে বলা হয় পেডোফিলিয়া বা বাল্যকামীতা। যারা শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত তাদের পেডোফিল বা বাল্যকামী বলা হয়। এমন না যে, এরা কেবল মেয়ে শিশুদের প্রতি আসক্ত, এরা ছেলে শিশুদের প্রতিও আকৃষ্ট হতে পারে।
সারাবিশ্বে বাল্যকামী লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এ পর্যন্ত যতগুলো গবেষণা হয়েছে তাতে পেডিফিলিক হওয়ার পেছনে তেমন কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমাদের দেশে পেডিফিলিয়া বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা তথা বিচারহীনতাকেই আমি দায়ী বলে মনি করি। ডা. ফাহমিদা নীলা করতোয়া’কে বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীকে চিহ্নিত এবং তার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে এ ধরনের অপরাধের হার কমে আসবে।
পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা, পাবিরিক শিক্ষা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধেরও কোন বিকল্প নেই। এ দেশের ছোট-বড় সকল নাগরিককে সোচ্চার হতে হবে। আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী এড. দিলরুবা নূরী করতোয়া’কে বলেন, মনস্তত্বগত কারণেই সমাজে ধর্ষণের মত ঘটনা বেড়েছে। ধর্ষণের মনস্তত্ব গড়ে ওঠে জবরদস্তি মনোভাব থেকে। এছাড়া নারীর প্রতি অধঃস্তন মনোভাব ও ক্ষমতা প্রয়োগের মনোভাবও অনেকটা দায়ী।
ধর্ষণ মামলায় বিচারহীনতার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, পরিসংখ্যান বলছে এ ধরনের ৯৭ ভাগ মামলা বিচারো মুখ দেখে না। কারণ তদন্ত ঠিকমত হয় না। অনেক নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় বলে ভিকটিম ঠিকমত সাক্ষ্য দিতে পারেন না। যে অল্প কিছু মামলার বিচার শুরু হয় সেসব ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিকটিম, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং চিকিৎসকের সাক্ষ্য ঠিকমত পাওয়া যায় না। ফলে আসামীরা খালাস পেয়ে যায়। ফলে শেষ পর্যন্ত মাত্র শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ আসামী দন্ডিত হয়। এই যে বিচারহীনতা এটিও অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে তোলে।
বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী নিয়তি সরকার নিতু করতোয়ার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সারাদেশে নারীর উপর নির্যাতন ও ধর্ষণ যেভাবে বেড়েছে তাতে জনসাধারণের জীবন অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। ৮ বছরের শিশুসহ মধ্য বয়সী নারীরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। একদিকে আইন উপদেষ্টা ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষকদের বিচার নিশ্চিতের কথা বলছেন। এই সময়টাকেও আমাদের কাছে দীর্ঘ মনে হয়। চোখের সামনে সব প্রমাণ থাকলে এত সময় নিতে হবে কেন?
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক করতোয়া’কে বলেন, অনেক কারণেই দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। বিভিন্ন মহলের নারী বিদ্বেষী বক্তব্যও কম দায়ী নয়। তার মতে রাজনৈতিক দল, এনজিও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভা সমাবেশ ও বৈঠকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলা দরকার। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখার বিষয়েও আলোচনা করা দরকার।
এই বিষয়ে বগুড়ার বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষ করতোয়া’কে বলেন, যারা ধর্ষণের মত ঘৃণ্য কাজ করে শিশু বা নারীদের টার্গেট করে থাকেন, যেন সহজে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে। এছাড়া কিছুটা বায়ো-সাইকো সোস্যাল ফ্যাক্টর বা বংশগত বিষয়। এই অনুপাত খুবই কম। কারণ যার বাবা ধর্ষক তার ছেলে বা নাতিও ধর্ষক হতে পারে। তবে এটা যে সব সময় ঘটবে ৭ থেকে ১০ শতাংশ। মাগুরায় ৮ বছরের যে শিশুটিকে একই পরিবারের তিন সদস্য মিলে ধর্ষণ করেছে সেটি জিনগত কারণেই করা হয়েছে। এছাড়া আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেও ধর্ষণের হার বাড়ে।
মন্তব্য করুন