অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে নারী ও শিশু আক্রান্তের হার

স্টাফ রিপোর্টার : বারো বছর বয়সী তুর্বের ওজন ৬৫ কেজি। সাধারণত ওই বয়সী শিশুর ওজন ৩১ থেকে ৩৫ কেজির মধ্যেই হয়ে থাকে। তুর্বের শুধু যে ওজন বেশি তা নয়, ইদানিং প্রায়ই সে পেটের ব্যথার কথা বলে। এছাড়া আগের মত খাবারের প্রতি তেমন আর আগ্রহ নেই। এমন অবস্থায় তুর্বের বাবা-মা’ বাধ্য হয়ে তাকে নিয়ে গ্যাস্টোলিভারের চিকিৎসককের কাছে যান। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরিক্ষা শেষে জানান তুর্বের শরীরে ফ্যাটি লিভারের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী জিন্নুতের দিনদিন যেমন ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে মাথা ঘোরা, দুর্বল বোধ করাসহ প্রায়ই বমি বমি ভাব লাগে। স্বাভাবিক শরীর খারাপ লাগা ভেবে প্রথমে চিকিৎসকের কাছে না গেলেও পরবর্তীতে পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ায় জিন্নুত চিকিৎসকের কাছে গেলে নানা পরীক্ষা শেষে তার লিভারে অতি মাত্রায় চর্বি জমেছে বলে জানা যায়। এ কারণেই শরীরে তার এই লক্ষণগুলো দেখা গিয়েছিলো বলে চিকিৎসকরা জানান। চিকিৎসক জানান, ওষুধের পাশাপাশি জিন্নুতের খাবার ও জীবন-যাপনে তার পরিবর্তন আনলে সুস্থ হতে পারবেন।
তুর্ব-জিন্নুতই নন, দেশে প্রতি বছরই বাড়ছে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবে শঙ্কার বিষয় হলো আগে এই রোগে শুধু অ্যালকাহোলিক পুরুষরা আক্রান্ত হলেও এখন নারী ও শিশু আক্রান্তের হার বেশি। ২০২৪ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ফ্যাটি লিভারে ভুগছেন এবং এর মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষের সিরোসিস বা লিভার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি আছে। আর এসব শঙ্কা নিয়েই আজ পালিত হবে বিশ্ব ফ্যাটি লিভার দিবস।
চিকিৎসকরা বলছেন, স্থ’লতা, কায়িক পরিশ্রম না করা এবং বিলাসী জীবন যাপনের জন্য দেশে দিন দিন ফ্যাটি লিভারের রোগী আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, হাঁটার অভ্যাস, জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন ও ওজন কমানোর মাধ্যমে ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধ করা যায়।
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের লিভার বিভাগের করোনার আগে করা এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে লিভার বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা ১ হাজার ৭৫৬ জন রোগীর মধ্যে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং স্বল্প মেয়াদী জন্ডিসে আক্রান্ত ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে ২ হাজার ১৩৪জন রোগীর মধ্যে নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে।
অবশ্য লিভার সিরোসিস এবং স্বল্প মেয়াদী জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কম। শজিমেক হাসপাতালের লিভার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. এ এস এম সাদেকুল ইসলাম জানান, ওই বিভাগে ২০১৭ সালে লিভার রোগে আক্রান্ত হওয়া ৯৪০জন রোগীর মধ্যে ২২০ জন অর্থাৎ ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীই ছিলেন লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত।
এরমধ্যে হেপাটাইটিস বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত ৭ দশমিক ৩ শতাংশ রোগী। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী লিভার রোগে আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিলেন ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে লিভার বিভাগে ভর্তি হওয়া ১০৫০ জন রোগীর মধ্যে লিভার সিরোসিস আক্রান্ত ছিলেন ২৮০ জন। তবে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমে। তবে লিভারের অন্যান্য রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।
আরও পড়ুনপ্রধান ডা. এ এস এম সাদেকুল ইসলাম জানান, আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের জন্য প্রতিনিয়ত ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে এই রোগে পুরুষের বিশেষ করে অ্যালকোহলিকদের আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিলো। কিন্ত আশঙ্কার কথা এখন অ্যালকোহলিকদের পাশাপাশি নন অ্যালকোহলিকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশেষ করে শিশু ও নারীরা। শিশুদের এই রোগে আক্রান্তের হার ৩৩ শতাংশ এবং নারী বিশেষ করে ৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী নারীদের এই রোগে আক্রান্তের হার ৫২ শতাংশ। কায়িক পরিশ্রম না করা, বিলাসী জীবন-যাপন বিশেষ করে ফাস্ট ফুড, চর্বি ও তেল জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, শিশুদের খেলাধুলার পরিবর্তে ঘরে বসে স্কিন গেমসে আসক্ত হওয়ায় যেমন একদিকে স্থু’লতা বাড়ছে তেমনি ফ্যাটি লিভারসহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
ডা. সাদেকুল বলেন, কিডনির মতোই লিভারের রোগও একটা পর্য়ায়ের পর সারানো যায় না। লিভারের সংক্রমণের একটি বিশেষ পরিস্থিতিকে হেপাটাইটিস বলা হয়ে থাকে। ফলে আগে থেকেই লিভারের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা উচিৎ। খাদ্য বা পানীয় হিসেবে যাই গ্রহণ করা হয়, সবকটিই লিভারের মধ্যে দিয়ে যায়। সাধারণত লিভারের সমস্যার কোনও উপসর্গ চট করে পাওয়া যায় না। যখন উপসর্গ বোঝা যায়, ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।
তিনি বলেন, সিরোসিস অফ লিভার হল লিভার রোগের শেষ পর্যায়। এখানে থেকে ফিরে আসার কোনও উপায় নেই । এর মানে হল লিভার সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । আসলে প্রথমে ফ্যাটি লিভার হল, অর্থাৎ লিভারটি বড় হয়। তারপর লিভার শক্ত হয়ে যায়। তখনও যদি আমরা সতর্ক না-হই তাহলে লিভারটি ফেটে যায়। একেই বলে সিরোসিস অফ লিভার । অতএব ফ্যাটি লিভার হল সিরোসিস অফ লিভারের প্রথম ধাপ।
ডা. সাদেকুল বলেন, লিভার ভাল রাখতে বেশ কিছু দিকে খেয়াল রাখতে হয়। অতিরিক্ত মদ্যপান বা নেশাদ্রব্য নেওয়া বন্ধ করতে হবে। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ না করে যখন তখন যে কোনও ওষুধ খাওয়া যাবে না। সব্জি, শাকপাতা বিশেষ করে ফুলকপি-ব্রকোলি জাতীয় সব্জি, মওসুমি ফল খেতে হবে। ফাইবার রয়েছে এমন খাবার ডায়েটে রাখতে হবে। এছাড়াও রসুন, আপেল, আঙুর, লেবু লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
মন্তব্য করুন