বগুড়ার অপরাধ জগতের ‘ডন’ মতিন সরকার গ্রেফতার, ৬ দিনের রিমান্ডে, আদালতে জনতার রোষাণলে

স্টাফ রিপোর্টার ও কোর্ট রিপোর্টার : বগুড়ার অপরাধ জগতের ‘ডন’ চারটি হত্যাসহ ২০ মামলার আসামি, বগুড়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর, (কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) যুবলীগের বহিস্কৃত নেতা এবং দুদক’র মামলায় ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি আব্দুল মতিন সরকারকে (৫০) গ্রেফতার করা হয়েছে। বগুড়া জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবি’র একটি টিম গতকাল শনিবার রাত ১১টার দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে।
এরপর আজ রোববার (২২ জুন) বেলা ৩টার দিকে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাকে হাজির করে স্কুল শিক্ষক সেলিম হোসেন হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি’র এসআই আবু জাফর। আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ৬ দিনের রিমান্ড মুঞ্জুর করলে তাকে ডিবি কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে।
এর আগে তাকে আদালতে তোলার সময় বিক্ষুদ্ধ জনতার রোষাণলে পড়ে মতিন সরকার। পুলিশের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে হেলমেট ও জ্যাকেট পরে তাকে আদালতে হাজির করার সময় উপস্থিত বিক্ষুব্ধ জনতা তার ওপর চড়াও হন। তাকে লক্ষ্য করে পঁচা ডিম ছুঁড়ে মারে এবং এক পর্যয়ে তাকে মারধোরও করেন। সেইসাথে আদালত চত্বরে জনতা ও নির্যাতিত পরিবারের লোকজন মতিন সরকারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন। এসময় মতিনের শ্যালক মিল্লাতকে আদালতে চত্বরে পেয়ে তাকে গণধোলাই দেন জনতা। তখন পুলিশ মিল্লাতকে উদ্ধার করে।
যেভাবে ধরা পড়লো মতিন সরকার : গতকাল শনিবার রাত ১১টার দিকে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার জিদান আল মুসার দিকনির্দেশনায় জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)’র ওসি মো: ইকবাল বাহারের নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালিত হয়। এর আগে তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতায় বগুড়া জেলা ডিবি’র দলটি ঢাকার মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায় মতিন সরকারে অবস্থান নিশ্চিত করে। এরপর ডিবি’র ওই দলটি বসিলা এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের দোতলায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। মতিন সরকার সেখানে ওই ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া নিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে গোপনে বসবাস করে আসছিল।
পিছু লেগেছিল ডিবি : বগুড়ার অপরাধ জগতের ‘ডন’ বলে পরিচিত মতিন সরকারকে গ্রেফতারের জন্য পিছু লেগেছিল ডিবি। গত ৫ মাস ধরে তাকে গ্রেফতারের জন্য একাধিকবার ঢাকায় অভিযান চালিয়েছে ডিবি। ডিবি’র ওসি জানান, তাকে গ্রেফতারের জন্য এর আগে দুই দিন ধরে ঢাকায় অবস্থান করেও ধরতে পারেনি ডিবি। ঢাকার উত্তরা ও মীরপুরে তার নিজের দুটি বাড়িও রয়েছে।
কিন্তু সে তার বাড়িতে থাকতো না। নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া থাকতো ঢাকার মোহাম্মদপুরে বসিলা এলাকায়। যে কারণে তার নিজেস্ব বাড়ি দুটিতে তাকে পাওয়া যায়নি। অবশেষে তথ্য প্রযুক্তির সহযোগিতায় নিখুঁত গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত শনিবার রাত ১১টার দিকে বসিল এলাকায় ওই ফ্ল্যাট থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
মতিনের যত মামলা : আব্দুল মতিন সরকার বগুড়ার অপরাধ জগতের ‘ডন’ বলে পরিচিত। পুলিশের খাতায় শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবেও তার নাম রয়েছে। তার বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলাসহ ২০টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে গত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনকারী স্কুল শিক্ষক সেলিম হোসেন হত্যা মামলারও সে আসামি।
এছাড়া ইমরান হত্যাকান্ডসহ চাঁদাবাজি, বিএনপি অফিসে হামলা, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, দখলবাজির অভিযোগে মামলা রয়েছে। ২০১৩ সালে শহরের চকসুত্রাপুরে সন্ত্রাসীরা বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ইমরান নামে এক যুবককে হত্যা করে। সেই হত্যা মামলায় আসামি ছিল মতিন সরকার। হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে মতিনকে আসামি করা হয়।
মতিনের প্রভাব : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুবই প্রভাবশালী সে। তার নির্দেশে রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীরা উঠবস করতো। তার প্রভাব এতটাই ছিল যে, তৎকালিন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা শহরের চকসুত্রাপুর চামড়া গুদাম এলাকায় তার বাড়িতে আসতেন। কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালিন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানেরও তার বাড়িতে যাতায়াত ছিল।
আরও পড়ুনমন্ত্রী তার বাড়িতে দুপুরের খাবারও খেয়েছেন। তৎকালিন স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথেও নিবিড় যোগাযোগ ছিল তার। কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্যান্য প্রভাবশালীদের মত মতিন সরকারেরও পতন হয়। পালিয়ে যায় বগুড়া থেকে। কিন্তু পালিয়ে থেকেও শেষ রক্ষা হলো না মতিনের। অবশেষে ডিবি’র হাতে ধরা পড়লো মতিন সরকার। তার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই -আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে দুটি হত্যাসহ ২০টি মামলা রয়েছে।
৬ দিনের রিমান্ড মুঞ্জুর : আব্দুল মতিন সরকারকে (৫০) আজ রোববার (২২ জুন) বেলা ৩টার দিকে আদালতে হাজির করা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। ওই আসামিকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে ঘটনার রহস্য উৎঘাটন ও তথ্য সংগ্রহ, পলাতক আসামিদেরকে গ্রেফতার, অজ্ঞাতনামা আসামিদেরকে শনাক্তকরণ, প্রকৃত পরিকল্পনাকারী ও ইন্ধনদাতাকে শনাক্ত করাসহ ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রসমূহ উদ্ধারের লক্ষ্যে এই রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো, মেহেদী হাসান, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং আসামি আব্দুল মতিন সরকারের উপস্থিতিতে শুনানি শেষে ৬ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
সেলিম হত্যা মামলা : স্কুল শিক্ষক সেলিম হোসেন হত্যাকান্ডের পর মামলা দায়ের করা হয়। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার পালিকান্দা এলাকার মৃত সোলায়মান আলীর ছেলে বগুড়া শহরতলীর ইসলামপুর হরিগাড়ীতে বসবাসকারী সেলিম হোসেনের বাবা মো. সেকেন্দার আলী গত বছরের ১৬ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু, সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপুসহ ১০১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ জনকে আসামি হিসেবে উল্লেখ করে এই মামলা দায়ের করেন।
তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন, তার ছেলে সেলিম হোসেন (৩৫) কাহালু উপজেলার মুড়ইল লাইট হাউজ স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তার ছেলে সেলিম হোসেন দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত বছরের ৪ আগস্ট বেলা ৩টার সময় শহরের সাতমাথা স্টেশন রোডে পুরাতন আইএফআইসি ব্যাংকের কাছে মিছিলে যান।
এসময় এই মামলার আসামি ফ্যাসিস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হুকুমে আসামিরা হামলা চালিয়ে ককটেল বিস্ফেরণ, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপসহ ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ও মারপিট করে সেলিম হোসেনকে ঘটনাস্থলে হত্যা করে আসামিরা পালিয়ে যায়।
১৩ বছরের কারাদন্ড : দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বগুড়ার দায়েরকৃত মামলায় আব্দুল মতিন সরকারকে সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানের অপরাধে চলতি বছরের ১১ মার্চ তিন বছরের সশ্রম কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়। সেইসাথে জ্ঞাত আয়ের উৎস বহির্ভূত অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করে দখলে রাখার জন্য তাকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং ২ কোটি ২৮ লাখ ৩১ হাজার ৩১৫ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৬ মাসের সশ্রম কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়।
রায়ে আসামির জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ অর্জিত ২ কোটি ২৮ লাখ ৩১ হাজার ৩১৫ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত এবং উভয় সাজা আলাদাভাবে চলবে মর্মে উল্লেখ করা হয়। জরিমানা ও বাজেয়াপ্তকৃত টাকা সাজাপ্রাপ্ত আসামির সম্পত্তি বিক্রি করে আদায়ের জন্য জেলা কালেক্টর বগুড়া বরাবর রায়ের অনুলিপি প্রেরণের জন্য বলা হয়।
সাজাপ্রাপ্ত আসামি পলাতক এবং আত্মসমর্পণ কিংবা গ্রেফতারের পর থেকে তার সাজা কার্যকর হবে। বগুড়ার স্পেশাল জজ মো. শহিদুল্লাহ এই মামলার রায় দেন। আব্দুল মতিন বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুরের মজিবর রহমান সরকারের ছেলে এবং দেশের বহুল আলোচিত ‘তুফান কান্ডের’ তুফান সরকারের বড় ভাই।
মন্তব্য করুন