আতংকে হাসপাতাল ছেড়েছেন অধিকাংশ চিকিৎসক-নার্স, ৪ ঘণ্টা যাবৎ সেবা বন্ধ

চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে’ আহতদের একাংশের হামলার ঘটনায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে টানা চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হামলার পর নিরাপত্তাহীনতায় পড়া অধিকাংশ চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীই দুপুরের দিকে হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছেন। এরফলে জরুরি বিভাগ ব্যাতিত হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে হাসপাতালটিতে এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে দুর্ভোগে পড়েছেন চিকিৎসা নিতে আসা শত শত রোগী।বুধবার (২৮) সকাল ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আহতের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলেও সমাধান হয়নি।
উত্তপ্ত পরিস্থিতি থামাতে লাঠিচার্জ করতে দেখা গেছে সেনবাহিনীকে।হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গতকাল চক্ষু বিজ্ঞান পরিচালকের গায়ে হাত তুলেছে একদল জুলাই আহত ব্যক্তিরা। এমনকি তারা হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপরও হামলা করে রুম ভাঙচুর করে। এরই ধারাবাহিকতায় চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারিরা মিলে আজ (২৮ মে) সকাল থেকে কর্মবিরতি পালন শুরু করে। এরপর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি এবং দুই পক্ষের ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে সকাল ১১টা থেকে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আবারও উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, আন্দোলনকারী আহতদের একাংশ হাসপাতালের কর্মীদের মারধর করেছেন, রুমে ভাঙচুর করেছেন এবং এমনকি পরিচালকের গায়েও হাত তুলেছেন। এই ঘটনার পর তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন এবং কর্মবিরতি ঘোষণা করেন। কিন্তু কোনোরকম উস্কানি ছাড়াই আজ আবারও তারা হামলা চালায়, যাতে অন্তত দশজন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগীও রয়েছেন। সংঘর্ষের ঘটনায় থমথমে অবস্থা হাসপাতালে। বন্ধ হয়ে গেছে সেবা।
ঘটনার শুরু : বিষপানের হুমকি থেকে উত্তেজনা
ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার (২৭ মে) বিকেলে। জানা গেছে, গত বছর জুলাইয়ে চোখ হারানো চার আন্দোলনকারী—শিমুল, সাগর, মারুফ ও আবু তাহের—হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে বৈঠকে বসে। চিকিৎসাসেবায় অবহেলা ও বিদেশে রেফার না করা নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা আচমকা পকেট থেকে বিষের শিশি বের করে গলায় ঢালার চেষ্টা করেন। তাদের অবস্থা সংকটাপন্ন হলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
পরদিন সকাল থেকেই হাসপাতালের স্টাফদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তারা অভিযোগ করেন, আন্দোলনকারীরা শুধু বিষপানেই ক্ষান্ত হননি, তারা পরিচালকের কক্ষে ভাঙচুর করেছেন, গায়ে হাত তুলেছেন এবং কর্মীদের হুমকি দিয়েছেন।
চিকিৎসকদের প্রতিক্রিয়া: নিরাপত্তাহীনতায় কর্মবিরতি
হাসপাতালের চিকিৎসক নুরে আলম বাবু বলেন, “আমাদের পরিচালকের গায়ে হাত তোলা হয়েছে, অফিস রুম ভাঙচুর করা হয়েছে। তাই আমরা চিকিৎসক-নার্স-কর্মচারীরা কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে কর্মবিরতিতে গিয়েছি। কেউ সংক্ষুব্ধ হলেই গায়ে হাত তোলার এই সংস্কৃতি আর মেনে নেওয়া যায় না।”
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র নার্স বলেন, “তাদের তো আমরা ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা করেছি। এখন তারাই আমাদের মারছে, জোর করে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছে।”আহতদের পাল্টা অভিযোগ: চিকিৎসা নয়, নির্যাতন পেয়েছি
অন্যদিকে আন্দোলনকারী আহতদের ভাষ্য একেবারে বিপরীত। তারা দাবি করছেন, সকালে নাস্তা করতে নামার সময় কয়েকজনকে মারধর করেন হাসপাতালের কর্মীরা। পরে সেই খবর ছড়িয়ে পড়লে আহতরাও প্রতিক্রিয়া দেখান।
চিকিৎসাধীন ইব্রাহিম বলেন, “আমরা কারো গায়ে হাত দেইনি। সেনাবাহিনী পর্যন্ত আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে। চিকিৎসা না পেয়ে আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। ১০ মাস ধরে হাসপাতালের বেডে পড়ে আছি, রেফার করা হয়নি।”
বিষপানকারী আবু তাহের বলেন, “পরিচালকের সঙ্গে আমাদের বরাদ্দের অর্থ নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তিনি কথা না শুনে চলে যান। বাইরে যাওয়ার কথা বললেই চোখে ইনফেকশন হয়, আবার হাসপাতালে ফিরতে হয়। চিকিৎসা তো হচ্ছে না, বরং টাকা আত্মসাৎ করছে একটি সিন্ডিকেট।”
সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও জরুরি বিভাগ ব্যতীত সব বন্ধ
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আনসার, পুলিশ ও নৌবাহিনী ব্যর্থ হলে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট হাসপাতালে প্রবেশ করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আহতদের ওপর লাঠিচার্জ করতে দেখা গেছে। এরপর আহতরা পিছু হটে যায়।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ছাড়া সব চিকিৎসা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। রোগীরা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও সেবা পাচ্ছেন না। অনেকের অপারেশন ছিল আজকের নির্ধারিত শিডিউলে, সেটিও বাতিল হয়েছে।বাবুল মিয়া নামের একজন অস্ত্রোপচারের রোগী বলেন, আজকে আমার অস্ত্রোপচারের তারিখ ছিল। কিন্তু আন্দোলন এবং হামলার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এখন পরবর্তী ডেট আবার কবে বলতে পারছি না।
পরিচালক বলছেন, ‘জিম্মি’ চিকিৎসক-নার্সরা
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, “সব জানেন আপনি। আমার চিকিৎসক-নার্সরা এখনো জিম্মি। পরিস্থিতি উত্তপ্ত। বিকেলে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক রয়েছে, সেখানেই করণীয় ঠিক হবে।”
তিনি আরও জানান, গতকালের একটি অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে স্টাফরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যার কারণে তারা কর্মবিরতিতে গেছেন বলে আমি জানি। তবে আমি ছুটিতে, আমার পরিবর্তে আরেকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন