তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন সামগ্রিক প্রভাব বিবেচনা করেই অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত

এফসিটিসির ৫.৩ ধারা ও বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুসারে তামাক কোম্পানিসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনায় বাধা নেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করতে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট এবং বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে যে কোনো সংশোধনী আনার আগে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টা কমিটি। আইন সংশোধনের সামগ্রিক প্রভাব বিবেচনায় নিয়েই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কোম্পানি, চাষি, খুচরা বিক্রেতা, হকার, রাজস্ব সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ সব অংশীজনের মতামত নেওয়া জরুরি। তবে কেউ কেউ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) ৫.৩ নম্বর ধারা দেখিয়ে বলছেন, তামাক আইন সংশোধনে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শ করা যাবে না। কিন্তু এটি এফসিটিসির ৫.৩ ধারার সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। কারণ এফসিটিসির এই ধারা ও নির্দেশিকা অনুযায়ী, তামাক কোম্পানিসহ অংশীজনের সঙ্গে সংলাপে কোনো বাধা নেই। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) গৃহীত হয়।
এফসিটিসির ৫.৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত জনস্বাস্থ্য নীতিমালা নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সদস্য রাষ্ট্রকে জাতীয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নীতিমালাগুলোকে তামাক শিল্পের বাণিজ্যিক ও অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’ ধারাটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সে বিষয়ে ‘গাইডলাইন্স ফর ইমপ্লিমেন্টেশন আর্টিকেল ৫.৩’ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এফসিটিসির ৫.৩ ধারা ও এ সম্পর্কিত বাস্তবায়ন নির্দেশিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, তামাক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ বা আলোচনায় কোনো বাধা বা নিষেধ নেই। বরং তা হতে হবে নিয়ন্ত্রিত ও স্বচ্ছ। নির্দেশিকায় এ সম্পর্কিত আলোচনা বা সিদ্ধান্তগুলো যথাযথভাবে নথিভুক্ত করার পাশাপাশি স্বচ্ছতার সঙ্গে তা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কাজেই কোম্পানি, কৃষক, হকার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীসহ অংশীজনের মতামত নেওয়া এফসিটিসির লঙ্ঘন নয়। ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস এফসিটিসির ৫.৩ ধারার ব্যাখ্যা দিয়ে একটি রায় দেন।
আদালত বলেন, ‘এই ধারা তামাক শিল্পকে নীতি নির্ধারণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়ার নির্দেশনা দেয় না’। আদালত আরও জানান, এফসিটিসির বাস্তবায়ন নির্দেশিকাগুলো আইনগত বাধ্যবাধকতা নয়, বরং এটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তার জন্য প্রস্তাবিত নীতিমালা মাত্র। এফসিটিসির ধারা ও নির্দেশিকায় দেশের নিজস্ব আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পদেক্ষপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও প্রশাসনিক নীতিমালাও অংশীজনের সঙ্গে আলোচনাকে অনুমোদন দেয়। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) অনুসারেও জনস্বার্থে অংশীজনকে ডাকা, পরামর্শ নেওয়া বা আলোচনা আইনসিদ্ধ। ২০০৫ সালে আইন প্রণয়নের সময়ও তোমাক কোম্পানি ও অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করেছিল সরকার। একক খাত হিসেবে তামাক থেকেই সবচেয়ে বেশি রাজস্ব পায় সরকার। এ খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা সরকারের মোট রাজস্ব আদায়ের প্রায় ১০ শতাংশ।
আরও পড়ুনএ ছাড়াও অক্সফোর্ড ইকনোমিকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখ কৃষক তামাক চাষ করেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তামাক চাষের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। পাইকারি ও খুচরা বিক্রিতে মোট কর্মসংস্থানের ১৪ শতাংশ হয়েছে তামাক খাতে । ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সনে সংশোধিত)- এর অধিকতর সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া হয় কয়েক বছর আগে। অন্তবর্তী সরকার গত বছরের ৭ নভেম্বর প্রস্তাবিত সংশোধনী পর্যালোচনা করতে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। সম্প্রতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এ কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, বৈঠকে কমিটির প্রধান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু সংশোধনের ফলে সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব পড়বে সেগুলোও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। দেশে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে কোনো ইলাস্টিক রেভিনিউ সোর্স নেই। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাজস্ব আয়ের ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বিকল্প পথও খুঁজতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত গ্রহণ ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।‘
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব বিবেচনায় অংশীজনের সঙ্গে এ আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত কোনো সংশোধন হলে এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যেতে পারে। হুমকির মুখে পড়বে বিপুল সংখ্যক কৃষক, খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতার জীবন-জীবিকা। চোরাচালান, ভুয়া বা নকল পণ্যের বিস্তার বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।
মন্তব্য করুন